পশুর চামড়া সংরক্ষণে সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ব্যবহার উপযোগী করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গবেষকরা। নতুন পদ্ধতিতে লবণের পরিবর্তে পার অ্যাসিটিক অ্যাসিড ব্যবহার করে চামড়া এক মাসেরও বেশি সময় সংরক্ষণ করা সম্ভব।
গবেষণার প্রধান গবেষক বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের গবেষণাগারে ২০২৩ সাল থেকে এ গবেষণা শুরু হয়। সহ-গবেষক হিসেবে ছিলেন বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্স শিক্ষার্থী মো. নাদিম হাসান।
গবেষণাটি আন্তর্জাতিক জার্নালে ‘সল্ট ফ্রি প্রিজারভেশন অব অ্যানিমেল স্কিন: অ্যান ইকো ফ্রেন্ডলি অ্যাপ্রোচ’ শিরোনামে জমা দেওয়া হয়েছে। গবেষণার মূল লক্ষ্য, পরিবেশে লবণজনিত দূষণ কমিয়ে পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে চামড়া সংরক্ষণের কার্যকর উপায় নির্ধারণ।
লবণের বিকল্প পার অ্যাসিটিক অ্যাসিড: পার অ্যাসিটিক অ্যাসিড চামড়ার চর্বি, অর্গানিক ম্যাটার ও ময়লা দূর করে ফাঁকা জায়গা সৃষ্টি করে। এতে ট্যানিংয়ের সময় চামড়ার মধ্যে বেশি পরিমাণে ক্রোমিয়াম প্রবেশ করতে পারে এবং কোলাজেন প্রোটিনের সঙ্গে শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করে। ফলে তুলনামূলকভাবে কম ক্রোমিয়াম ব্যবহার করেও কার্যকর ট্যানিং সম্ভব হয় এবং চামড়ার গুণগত মানও উন্নত হয়। গবেষণার ফলে দেখা গেছে, এই পদ্ধতিতে ১১ গুণ কম ক্রোমিয়াম পরিবেশে নির্গত হয়, যা পরিবেশ দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়। পাশাপাশি মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ভারী ধাতু ক্রোমিয়াম প্রবেশের সম্ভাবনাও হ্রাস পায়।
পরীক্ষামূলক সাফল্য: গবেষক দল জানিয়েছে, গরু ও ছাগলের চামড়া ২ গ্রাম/লিটার ঘনমাত্রার পার অ্যাসিটিক অ্যাসিডে ডুবিয়ে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে চামড়ায় কোনো পচন বা গঠনগত ক্ষতি দেখা যায়নি।
পরিবেশ ও অর্থনৈতিক দিক: প্রচলিত পদ্ধতিতে একটি খাসির চামড়া সংরক্ষণে ৩০০-৫০০ গ্রাম লবণ লাগে, যা পরবর্তী সময়ে নদী-নালা, খাল-বিলের পানিতে মিশে জলজ পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, পার অ্যাসিটিক অ্যাসিড ব্যবহারে পরিবেশ দূষণ ও শ্রম দুটোই সাশ্রয় হয়।
চামড়া ব্যবসায়ীদের আগ্রহ: গবেষকরা আরও জানান, পরীক্ষামূলক সাফল্যের কারণে চামড়া সংরক্ষণের এ পদ্ধতি বাণিজ্যিকভাবে কার্যকর হতে পারে। বিশেষ করে যারা পরিবেশ-সচেতন এবং কম খরচে চামড়া সংরক্ষণ করতে চান, তাদের জন্য এটি একটি টেকসই বিকল্প হতে পারে।
গবেষণার বিষয়ে প্রধান গবেষক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য, ট্যানিংয়ের আগ পর্যন্ত চামড়াটি যাতে পচে না যায়, সেটি নিশ্চিত করা। লবণের কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে পার অ্যাসিটিক অ্যাসিড একটি চমৎকার সমাধান। কোরবানির পর চামড়া ছাড়ানোর ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম পার অ্যাসিটিক অ্যাসিড মিশিয়ে এক মিনিট ডুবিয়ে নিয়ে বাতাসবিরোধী (এয়ারটাইট) অবস্থায় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করলে সহজেই এক মাস পর্যন্ত চামড়া ভালো থাকে।’
তিনি আরও জানান, ‘এই নতুন পদ্ধতিটি আরও বড় পরিসরে ব্যবহার করার জন্য সরকারের সহযোগিতা দরকার। কোরবানির সময় পরীক্ষামূলকভাবে কিছু এলাকায় এই পদ্ধতিতে চামড়া সংরক্ষণ করলে এর উপকারিতা আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। এজন্য সরকার চামড়া সংরক্ষণকারীদের প্রশিক্ষণ দিতে পারে এবং পার অ্যাসিটিক অ্যাসিড সহজলভ্য করতে উদ্যোগ নিতে পারে। জেলা প্রশাসন ও প্রাণিসম্পদ অফিস একসঙ্গে কাজ করলে এটি বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।’
মন্তব্য করুন