

শীত এলেই অনেকেরই মনে হয়, ঘুম যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। সকালে উঠতে কষ্ট হয়, সারাদিন ক্লান্ত লাগে, কাজের আগ্রহ কমে যায়। কেউ কেউ এটাকে অলসতা ভাবলেও বাস্তবে বিষয়টি মোটেও এমন নয়।
বিজ্ঞান বলছে, শীতের সঙ্গে মানুষের শরীর ও ঘুমের অভ্যাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। সূর্যের আলো কমে যাওয়া থেকেই মূলত এই পরিবর্তন শুরু হয়। মানুষের শরীরে একটি স্বাভাবিক সময়সূচি আছে, যাকে বলা হয় সার্কাডিয়ান রিদম। এই দেহঘড়ি সূর্যের আলো–অন্ধকারের ওপর নির্ভর করে।
শীতে দিন ছোট ও রাত বড় হওয়ায় এই দেহঘড়ির ছন্দ বদলে যায়, আর তার প্রভাব পড়ে ঘুম ও শক্তির ওপর।
শীতের ঘুম নিয়ে গবেষণায় কী পাওয়া গেছে?
‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন নিউরোসায়েন্স’ নামের বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ঘুমের ধরনও বদলায়। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন, গ্রীষ্মের তুলনায় শীতে মানুষ আরইএম (REM) ঘুম বেশি পায়।
আরইএম ঘুম হলো সেই পর্যায়, যখন আমরা স্বপ্ন দেখি। এই ঘুম স্মৃতিশক্তি, মানসিক স্থিতি ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদিও শীতে মোট ঘুমের সময় খুব বেশি না বাড়লেও ঘুমের গঠন ও মানে স্পষ্ট পরিবর্তন আসে।
গবেষণাটি কীভাবে করা হয়েছিল?
এই গবেষণায় প্রাপ্তবয়স্কদের রাতের ঘুম বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয়, যাকে বলা হয় পলিসমনোগ্রাফি। অংশগ্রহণকারীরা ল্যাবরেটরিতে অ্যালার্ম ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে ঘুমিয়েছিলেন। তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, শরীরের নড়াচড়া ও ঘুমের ধাপ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়—শীতকালে তারা গড়ে প্রায় ৩০ মিনিট বেশি আরইএম ঘুম পান।
এতে বোঝা যায়, আধুনিক শহরে কৃত্রিম আলো থাকলেও মানবদেহ এখনো ঋতুর পরিবর্তনে সাড়া দেয়।
শীতে কেন বেশি ক্লান্ত লাগে?
শীতে সূর্যের আলো কম থাকায় শরীরে মেলাটোনিন নামের হরমোনের নিঃসরণ বাড়ে। এই হরমোন ঘুমের জন্য দায়ী। আলো কম হলে শরীর ধরে নেয় বিশ্রামের সময় বেশি, ফলে সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব, মনোযোগের ঘাটতি ও শক্তি কমে যাওয়ার অনুভূতি দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শীতের দুর্বল আলো শরীরের স্বাভাবিক শক্তির মাত্রা কমিয়ে দেয়। তাই দিনের বেলাতেও মানুষ বেশি ক্লান্ত অনুভব করে।
মন-মেজাজ ও স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব
শীতে ঘুমের পরিবর্তন শুধু শরীরেই নয়, মনের ওপরও প্রভাব ফেলে। অনেকেই এ সময় মন খারাপ, হতাশ বা অস্থির অনুভব করেন। মনোযোগ কমে যেতে পারে, কাজের আগ্রহ হ্রাস পায়। কেউ কেউ বেশি মিষ্টি বা অস্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং শরীরচর্চা কমিয়ে দেন, যা আবার ঘুমের মান আরও খারাপ করে।
এ ছাড়া যাঁরা ঋতুগত বিষণ্নতা (Seasonal Affective Disorder)–তে ভোগেন, তাঁদের শীতে ঘুম ও মানসিক সমস্যার ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে।
শীতের সঙ্গে ঘুমের অভ্যাস কীভাবে মানিয়ে নেবেন?
গবেষকরা মনে করেন, আমাদের আধুনিক কাজ ও পড়াশোনার সময়সূচি শীতের স্বাভাবিক ঘুমের চাহিদার সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই নয়। তবে কিছু সহজ অভ্যাস মানলে শীতে ভালো ঘুম পাওয়া সম্ভব—
- রাতে একটু আগে ঘুমাতে যাওয়া
- ঘুমানোর আগে মোবাইল বা স্ক্রিন ব্যবহার কমানো
- শোয়ার ঘর ঠান্ডা, অন্ধকার ও শান্ত রাখা
- প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানো ও জাগার চেষ্টা করা
- দিনের বেলায় যতটা সম্ভব প্রাকৃতিক আলোতে থাকা
শীতে বেশি ঘুম পাওয়া বা ক্লান্ত লাগা কোনো দুর্বলতা বা অলসতা নয়, এটি শরীরের স্বাভাবিক জৈবিক প্রতিক্রিয়া। ঋতুর পরিবর্তনকে মেনে নিয়ে ঘুমের অভ্যাসে সামান্য পরিবর্তন আনলেই শীতকালেও শরীর ও মন দুটোই সুস্থ রাখা সম্ভব।
সূত্র : হিন্দুস্তান টাইমস
মন্তব্য করুন