মশার কয়েলের বিকল্প হিসেবে ‘বাজ শিল্ড’ উদ্ভাবন করেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। বাজারের প্রচলিত কয়েলের থেকে অধিক কার্যকর এই শিল্ড। মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয় বলে দাবি করেছেন শিক্ষার্থীরা।
তাদের এই উদ্ভাবন সম্প্রতি এফবিসিসিআই ইনোভেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার (এফবিসিসিআই আইআরসি) আয়োজিত প্রতিযোগিতায় সেরা দশে স্থান করে নিয়েছে। এটিকে আরও উপযোগী করতে কাজ করছে উদ্ভাবক শিক্ষার্থীরা।
গবেষণা কাজের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীরা জানান, সারা দেশে মশার উপদ্রব আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি বছর ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। এ অবস্থায় দেশের বাজারে প্রচলিত মশার কয়েল কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই ব্যর্থতার পাশাপাশি তা থেকে নির্গত ধোঁয়া মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করছেন চিকিৎসকরা।
এ ছাড়াও মশা তাড়াতে বিভিন্ন কোম্পানির যে ইলেকট্রিক যন্ত্র রয়েছে সেটিও স্বাস্থ্যসম্মত এবং কার্যকর নয়। বিষয়টি উপলব্ধি করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি টিম মশা তাড়াতে বিকল্প কিছু তৈরির চেষ্টা চালান। সেই চিন্তা থেকেই শিক্ষার্থীরা ‘বাজ শিল্ড’ উদ্ভাবন করেন। প্রাথমিক পরীক্ষায় এটি কার্যকর বলে দাবি করেছেন শিক্ষার্থীরা। এটি নিয়ে আরও গবেষণা করছেন তারা।
এই কাজটি যেসব শিক্ষার্থী বাস্তবায়ন করেছেন তারা হলেন সয়েল, ওয়াটার এন্ড এনভায়রনমেন্ট ডিসিপ্লিনের ২১ ব্যাচের নিশাত জাহান নাদীরা (সিইও), ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের ২২ ব্যাচের মো. মুকাররম হোসেন (মার্কেটিং, ডকুমেন্টেশন ও সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার), পরিসংখ্যান ডিসিপ্লিনের ২১ ব্যাচের মো. সৌরভ হোসেন (অ্যানালিটিকস অ্যান্ড ফিল্ড ম্যানেজার) এবং গণিত ডিসিপ্লিনের ২৩ ব্যাচের মেফাদুজ্জামান রাতুল (ফাইন্যান্স অ্যান্ড আইটি ম্যানেজার)।
টিমের সদস্য নিশাত জাহান নাদীরা বলেন, বর্তমান সময়ে মশা নিয়ে বিস্তর আলোচনা মানুষের মাঝে। ভাবা যায় চার সদস্যের একটি পরিবারে কমপক্ষে শুধু মশার পেছনে খরচ হয় ৮০০ থেকে হাজার টাকা। যার মাধ্যমে মানুষ নানা রোগের জন্ম দিচ্ছে। আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে কয়েলের বিকল্প নিয়ে ভাবা শুরু করি। দীর্ঘ ছয় মাস গবেষণা করে কয়েলের বিকল্প তৈরি করতে পেরেছি। প্রাথমিকভাবে এটি আমরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ময়ূর নদীসংলগ্ন এলাকায় প্রয়োগ করি এবং এটা এখন পর্যন্ত খুবই কার্যকরী ফল দিয়েছে। এটিকে আরও কার্যকর করতে আমাদের টিম কাজ করে যাচ্ছে।
এর কারিগরি দিক নিয়ে মো. মুকাররম হোসেন বলেন, মশা ওড়া, শব্দ তৈরি, কামড় দেওয়া থেকে সুরক্ষা দিতেই বাজ শিল্ড নাম দেওয়া হয়েছে। এটি তৈরিতে বেশি কিছু প্রয়োজন নেই। একটি পচনশীল ব্যাগ এবং তিন ধরনের ওষুধ। এই ওষুধগুলোও ন্যাচারাল এবং পরিবেশসম্মত। তবে তথ্য সংরক্ষণের স্বার্থে ওষুধগুলোর নাম বলতে রাজি হননি তিনি। ব্যাগে এক লিটার পানির মধ্যে ওষুধগুলো মেশালে এক ধরনের যৌগ তৈরি হবে। যেটা খোলা স্থানে রাখলে মশা আর মানুষের শরীর আকৃষ্ট করবে না। ওই ওষুধগুলোর দিকেই যাবে। এর ফলে ওষুধগুলোর মাধ্যমে মশার পাকস্থলিতে একটি প্রেটিন ক্রিস্টাল তৈরি করবে। এতে মশা এবং লার্ভা দুটোরই বংশবিস্তার প্রক্রিয়া নষ্ট হয়ে যাবে।
টিমের আরেক সদস্য মিফদুজ্জামান রাতুল বলেন, আমি গণিত বিভাগের। কিন্তু এই প্রজেক্ট তৈরিতে আমরা কারিগরি সহায়তা দিয়েছি। এটা এখনো পুরোপুরি বাজারজাত করার মতো হয়নি। আমরা সবেমাত্র গবেষণা শেষ করে এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করে সফল হয়েছি। এটি নিয়ে আরও কাজ চলছে, শিগগিরই এটি সহজে ব্যবহার উপযোগী করা হবে। এর জন্য ফান্ড প্রয়োজন।
টিমের চতুর্থ সদস্য সৌরভ হোসেন বলেন, আমাদের প্রজেক্টটি ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন হাব প্রোগ্রামের আওতায় ৫০ হাজার টাকার ফান্ড পেয়েছিলাম। যার মাধ্যমে তৈরি করেছি। এ ছাড়াও এফবিসিসিআই ইনোভেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার (এফবিসিসিআই আইআরসি) ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) আয়োজিত প্রতিযোগিতায় সারা দেশ থেকে প্রায় সাড়ে চারশ উদ্ভাবনের মধ্যে নির্বাচিত সেরা দশে স্থান করে নিয়েছে বাজ শিল্ড। এটির আরও গবেষণার জন্য একটি ছোট ফান্ড দিয়েছে আয়োজক সংস্থা। তবে বৃহৎ আকারে ব্যবহার উপযোগী করতে আরও ফান্ড প্রয়োজন বলে দাবি করেন তিনি।
শিক্ষার্থীদের এই উদ্ভাবন নিয়ে খুবি উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুধু একাডেমিক পড়াশোনাতেই নয়, গবেষণা ও উদ্ভাবনী শক্তিতেও সারা দেশে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবিত ‘বাজ শিল্ড’ ভবিষ্যতে দেশের জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও পরিবেশ সংরক্ষণে অবদান রাখবে।
মন্তব্য করুন