বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন শিক্ষক নিয়ে চলছে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছয়টি ব্যাচ। ফলে সেশনজটের আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে ওয়ার্ক ক্যালকুলেশন নীতিমালা অনুযায়ী বিভাগটিতে বর্তমান ১০ জনের অধিক শিক্ষক থাকার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত বিভাগটিতে মাত্র পাঁচজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে পাঁচজনের মধ্যে দুজন শিক্ষক ছুটিতে রয়েছেন। এতে প্রতি সেমিস্টারে একজন শিক্ষককে গড়ে ৬ থেকে ৮টি পাঠ নিতে হচ্ছে। এসবের মধ্যে পাঠদানের কক্ষ সংকটও তো আছেই। একটি কক্ষেই চলে ছয় ব্যাচের পরীক্ষা ও পাঠদান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষক বলেছেন, শিক্ষক সংকটরে কারণে ক্লাস, সেমিস্টার, মিড,পরীক্ষার খাতা দেখা ও পরীক্ষার ফলাফল শিট তৈরি করা এখন কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দশা শুধু যে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে আছে তা নয়, অন্যান্য বিভাগগুলোর একই অবস্থা। তবে শিক্ষক সংকট সবচেয়ে করুণ অবস্থা সাংবাদিকতা বিভাগেই। এতে করে ঠিক সময়ে ক্লাস, প্রেজেন্টেশন, অ্যাসাইনমেন্ট ও পরীক্ষায় বসতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা।
এদিকে শিক্ষক সংকটে অনেক বিভাগের সেমিস্টারের ফলাফল দিতেও লাগছে ৫ থেকে ৬ মাস। যেখানে ৬ মাসে সেমিস্টার শেষ করার কথা সেখানে ৮ মাসেও শেষ হয় না। কারণ, কিছু সংখ্যক শিক্ষক মিলে অনেকগুলো ব্যাচের খাতা দেখতে হয়। সে কারণে পরবর্তী সেমিস্টারের পরীক্ষা নিতেও দেরি হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অধিকাংশ বিভাগে দেখা যায় প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষক খুবই নগণ্য। গড়ে ৫৩ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে একজন শিক্ষক। যেখানে অর্গানোগ্রামভুক্তে ৪৫৩ জন শিক্ষক থাকার কথা সেখানে আছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ছাড়কৃত ২১০ জন।
তার মধ্যে পাঠদান নিচ্ছে বর্তমানে ১৬৫ জন। বাকি শিক্ষকরা রয়েছেন উচ্চতর ডিগ্রি নিতে শিক্ষা ছুটিতে। শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি কক্ষ সংকট প্রকোপ। প্রতিটি বিভাগের জন্য রয়েছে মাত্র একটি কক্ষ, তাও সেটি মৌখিকভাবে। অনেক সময় শিক্ষকরা নিজের বসার স্থানও পায় না। একটা ছোট রুমে পাঁচ-ছয় জন শিক্ষককে গাদাগাদি করে বসতে হয়।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহকারী অধ্যাপক ইমরান হোসেন জানান, ‘আমাদের বিভাগে পাঁচজন শিক্ষকের মধ্যে দুজন শিক্ষা ছুটিতে। এখন একজন শিক্ষককে গড়ে ৮টি করে কোর্সের ক্লাস নিতে হচ্ছে।এতে সেশনজটের ঝুঁকি বাড়তে পারে শিক্ষার্থীদের। ওয়ার্ক ক্যালকুলেশন নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষক চেয়ে আমরা চিঠি দিয়েছি কিন্তু কোনো সুফল আসিনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি আপাতত বাইরে থেকে খণ্ডকালীন শিক্ষক দেয় তাও একাডেমিক কার্যক্রম ভালোভাবে চালিয়ে নিতে পারব।’
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন সহযোগী অধ্যাপক দিল আফরোজ খানম বলেন, ‘যদি কোনো বিভাগের এমন দুর্দশা হয় তাহলে ডিন অফিস বরাবর আবেদন করতে পারেন। বিষয়টি বিবেচনা রেখে একাডেমিক কাউন্সিলের মিটিংয়ে প্রস্তাব রেখে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে সমাধান করা যেতে পেরে। এ বিষয়ে আমার সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫টি বিভাগ রয়েছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। ৬ থেকে ৭ টি ব্যাচের বিপরীতে পাঠদান করাচ্ছে প্রাণরসায়ন ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগে চারজন শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আছে ছয়জন, রসায়ন বিভাগে সাতজন, মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে চারজন, উপকূল ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগে পাঁচজন, অর্থনীতি বিভাগের সাত জন, মার্কেটিং বিভাগে ছয়জন, লোকপ্রশাসন বিভাগে ছয়জন ও ইতিহাস বিভাগে চারজন শিক্ষক।
উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণে ছুটিতে রয়েছেন অনেক শিক্ষক। ফলে সেশনজটের হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন রয়েছে আক্ষেপ, তেমনি সেশনজটের জন্য রয়েছে অনেক হতাশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েকদিন আগে আমি যোগদান করেছি। যোগদান করেই ইউজিসিকে চিঠি দিয়েছি যাতে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারেন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘আমার মুখ্য বিষয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করা। শিক্ষক সংকট দূরীকরণে আমরা বদ্ধপরিকর। যাতে শিক্ষার্থীরা সেশনজটের সম্মুখীন না হতে হয়, সে ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
শিক্ষক সংকটে শিক্ষার গুনগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুললে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট থাকলে সেটি শুধু গুনগত মান নয়, একটি বিভাগের সবদিকে প্রভাব পড়তে পারে। যদি ইউজিসির অর্গানোগ্রামে শিক্ষকের চাহিদা থাকে, তাহলে প্রত্যাশানুযায়ী শিক্ষক সংকট দূরীকরণে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। শিক্ষা ছুটিতে যারা আছেন, সেই সংখ্যার বিপরীতে নিয়োগ দিলে বিভাগের সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করছি।’
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অন্তত দুজন সদস্য জানিয়েছেন, ‘শিক্ষক নিয়োগের জন্য লোড ক্যালকুলেশন নীতিমালা না মেনে আবেদন করায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। তারা প্রতিবারই একই ভুল করে। সংশোধন করে দেওয়ার পর নীতিমালা মেনে যে বিভাগগুলো আবেদন করেছে সেগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। লোড ক্যালকুলেশন নীতিমালা মেনে আবেদন করলে অবশ্যই তারা শিক্ষক পাবেন।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সচিব অধ্যাপক ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ‘নীতিমালা মেনে আবেদন করলে অবশ্যই শিক্ষক পাবে। চার-পাঁচদিন আগে আমরা বেশকিছু বিভাগে শিক্ষক দিয়েছি। আমাদের এ প্রক্রিয়া চলমান থাকবে।’
মন্তব্য করুন