ভোটগ্রহণ শেষে গত রোববার (৭ জানুয়ারি) বিকালে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যলয় থেকে ঝিনাইদহ-১ (শৈলকুপা) আসনে ৪৯ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানানো হয়। কাস্টিং ভোটের ব্যাপারে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক এস এম রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ ছিল। কিন্তু ওই আসনের চূড়ান্ত ফলাফলে ৯ শতাংশ ভোট বেড়ে গেছে। ওই আসনের ফলাফলের তালিকায় মোট ৫৮ দশমিক ২৭ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে রিটার্নিং কর্মকর্তার সহযোগিতায় ভোটের ফলাফল ঘোষণায় ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী (ট্রাক প্রতীকের) নজরুল ইসলাম দুলাল বিশ্বাস। নৌকার প্রার্থীকে পাস করাতে তিনি এ ধরনের ভূমিকা রেখেছেন বলেও অভিযোগ করেন এ স্বতন্ত্র প্রার্থীর। এ ব্যাপারে আগামীকাল বুধবার (১০ জানুয়ারি) নির্বাচন কমিশন বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করবেন তিনি।
জানা যায়, এবারের ভোটে নৌকার প্রার্থী এমপি আব্দুল হাইয়ের বিতর্কিত ভূমিকায় প্রথম থেকেই ঝিনাইদহ-১ আসনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একের পর এক হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে এমপি হাই ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি নির্বাচন কমিশনের কাছে অন্তত ১০টি প্রতিবেদন পাঠায়। এসব প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন ৬টি মামলা দায়ের করে এমপি হাই ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনোভাবেই নির্বাচনে এমপি হাইয়ের অবৈধ প্রভাব বিস্তার ঠেকানো সম্ভব হচ্ছিল না। ভোটের দিনও তার লোকজন বিভিন্ন কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের ওপর হামলা ও ভয়ভীতি প্রদান করে। জালভোট প্রদানসহ নানা ধরনের অনিয়ম করে। এমনকি ওই আসনের হাকিমপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর কেন্দ্রের পোলিং অফিসার রাজু আহমেদ নিজেই নৌকায় সিল মারেন! এ সময় স্থানীয় সাংবাদিকরা দেখে ফেললে এবং ভিডিও চিত্র ধারণ করতে গেলে হাকিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও হাই সমর্থক ইকু শিকদারের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী তাদের ওপর হামলা চালায়। এ ছাড়া বিভিন্ন কেন্দ্রে জালভোট প্রদানের ঘটনা ঘটেনা ঘটে। নৌকায় জালভোট প্রদানের সময় হাকিমপুর ইউনিয়নের দোহারো মডেল বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে সাব্বির জোয়ার্দ্দার নামে একজনকে পুলিশ আটক করে।
সারা দিন ব্যাপক অনিয়মের মধ্য দিয়ে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর সবশেষে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ভোটের ফলাফলে ব্যাপক কারচুপি করে নৌকার পাল্লা ভারী করেন। বিকাল সাড়ে ৪টায় রিটার্নিং কর্মকর্তা তার কাস্টিং প্রতিবেদনে ঝিনাইদহ-১ আসনে ৪৯ শতাংশ ভোট পড়েছে মর্মে উল্লেখ করলেও চূড়ান্ত ফলাফলে ৫৮ দশমিক ২৭ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন। এ প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আব্দুল হাই ৯৪ হাজার ৩৭৯ ভোট পেয়েছেন। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী নজরুল ইসলাম দুলাল পেয়েছেন ৮০ হাজার ৫৪৭ ভোট। অন্যান্য প্রার্থী মিলিয়ে ওই আসনে মোট ভোট পড়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৪৯৪। আর আসনটিতে মোট ভোটার ছিল ৩ লাখ ৬ হাজার ৩৩৬ জন।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিকাল সাড়ে ৪টায় দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ী ৪৯ শতাংশ ভোট কাস্ট হলে মোট ভোট পড়ার কথা ১ লাখ ৫০ হাজার ১০৫টি। এর মধ্যে ট্রাক প্রতীকের প্রার্থী ৮০ হাজার ৫৪৭ ভোট পেয়ে থাকলে অবশিষ্ট কাস্টিং ভোট থাকে ৬৯ হাজার ৫৫৮টি। ৬৯ হাজার ৫৫৮টির মধ্যে অন্যান্য প্রার্থীর প্রাপ্য ভোট ও বাতিল ভোট ৩ হাজার ৫৬৮টি বাদ দিলে নৌকার প্রার্থী পায় ৬৫ হাজার ৯৯০টি ভোট। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফলে নৌকার প্রার্থী ৯৪ হাজার ৩৭৯ ভোট পেয়েছেন মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ রিটার্নিং কর্মকর্তার পক্ষ থেকে ভোটের দিন বিকাল সাড়ে ৪টায় দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভোটের সময় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ২৮ হাজার ৩৮৯টি ভোট বেড়ে গেছে। প্রায় ৯ শতাংশ ভোট বেড়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ৯শতাংশ ভোট কিভাবে পড়ল তার কোনো স্বচ্ছ জবাব নেই।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে ঝিনাইদহের ডিসি ও রিটার্নিং কর্মকর্তা এস এম রফিকুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, সাড়ে ৪টার দিকে যে প্রতিবেদন সেটা খসড়া ছিল। কিন্তু সর্বশেষ চূড়ান্ত করা হয়েছে, তখন দেখা যায় প্রায় ৫৮ শতাংশ ভোট পড়েছে।
জানতে চাওয়া হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নজরুল ইসলাম দুলাল বলেন, শৈলকুপার বিভিন্ন ইউনিয়ন, উপজেলা ও পৌর এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এমপি আব্দুল হাই নিজে ও তার ছেলেমেয়ে, কাছের আত্মীয়-অনুসারীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। সে কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তারা আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষে সুকৌশলে পক্ষপাতিত্ব করার আশঙ্কা করেছিলাম। সেজন্য পার্শ্ববর্তী উপজেলা থেকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন বরাবর চিঠি দিয়েছিলাম।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন তেমন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় পোলিং অফিসার ও প্রিসাইডিং অফিসাররা আব্দুল হাইয়ের পক্ষে কাজ করেছেন। পোলিং অফিসার নিজেই নৌকায় সিল মেরেছেন। অনেক কেন্দ্রে আমার এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ২১টি কেন্দ্রে জালভোট প্রদানসহ নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। আমি পুনরায় এসব কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের দাবি জানায়।
মন্তব্য করুন