রংপুরের পীরগাছায় প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে পার্শ্ববর্তী আরও দুই উপজেলায়। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) পীরগাছা থেকে সংগ্রহ করা ১২ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৮ জন অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত বলে নিশ্চিত করেছে। এতে জেলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
একইসঙ্গে মিঠাপুকুর ও কাউনিয়া উপজেলাতেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। এর মধ্যে মিঠাপুকুর উপজেলার চারজনের নমুনা পরীক্ষায় একজন অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে। আর কাউনিয়ার পাঁচজনের নমুনা সংগ্রহ করা হলেও এখনো রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, গত জুলাই ও সেপ্টেম্বরে রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে দুজন মারা গেছেন। একই সময়ে অ্যানথ্রাক্স রোগে উপজেলার চারটি ইউনিয়নে অর্ধশত ব্যক্তি আক্রান্ত হন।
গত আগস্টে পীরগাছা সদরের মাইটাল এলাকার কৃষক আব্দুর রাজ্জাক অসুস্থ গরু জবাইয়ের পর মাংস কাটতে গিয়ে আক্রান্ত হন। কয়েক দিনের মধ্যেই তার হাতে ঘা ছড়িয়ে পড়ে। পরে রংপুর কমিউনিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। পারুল ইউনিয়নের আনন্দী ধনিরাম গ্রামের গৃহিণী কমলা বেগম অসুস্থ গরুর মাংস রান্না করতে গিয়ে আক্রান্ত হন।
পরিবারের ভাষ্য, সেই রান্নার দুদিন পরই তার হাতে ঘা ওঠে এবং তা দ্রুত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। অবস্থা গুরুতর হলে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান।
এদিকে গত ১৫ সেপ্টেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ইমাদপুর ইউনিয়নের আমাইপুর গ্রামে কৃষক ইব্রাহিম মিয়ার একটি গরু অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে সেটি জবাই করা হলে আশপাশের লোকজন মাংস কাটাকাটি করেন। ঘটনার দুই দিন পর স্থানীয় চারজন— সোহরাব হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক, মনির হোসেন ও মজিবর রহমান চর্মরোগে আক্রান্ত হন। তাদের শরীর থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘ওই গরু কাটাকাটির কয়েক দিন পর দেখি হাতে ছোট ফোড়ার মতো বের হইছে। এখন দিনে দিনে বড় ঘায়ের মতো হচ্ছে। ডাক্তারের পরামর্শে এখন ওষুধ খাচ্ছি।’
স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, আক্রান্তদের অধিকাংশই গরু ও ছাগলের মাংস বা সংক্রমিত প্রাণীর সংস্পর্শে এসেছিলেন। নতুন করে আরও আট রোগীর নমুনা আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে।
পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্যানুসারে, অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া সরাসরি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে না এলেও বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা নিয়েছেন এমন আরও ২০ রোগীর তথ্য পাওয়া গেছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ তানভীর হাসনাত জানান, তাদের কাছে মোট ৫০ জন রোগীর তথ্য রয়েছে। বেশির ভাগ রোগী অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তবে তিনি দাবি করেছেন, এর আগে যে দুজন মারা গেছেন তাদের শরীরে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু থাকলেও মৃত্যু অ্যানথ্রাক্সের কারণে হয়নি। তাদের রিপোর্ট আইইডিসিআর দেখেছে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক তাহমিনা শিরীন জানান, পীরগাছা থেকে সংগ্রহ করা ১২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮ জনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে।
রংপুরের ডেপুটি সিভিল সার্জন রুহুল আমিন বলেন, পীরগাছার বাইরে কাউনিয়া ও মিঠাপুকুরেও আমরা একই ধরনের উপসর্গের রোগী পেয়েছি। ইতোমধ্যে আরও আট রোগীর নমুনা আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। সেটার রিপোর্ট এখনো আসেনি। অসুস্থ গবাদিপশু জবাই ও অসুস্থ প্রাণীর মাংস না খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
রুহুল আমিন আরও বলেন, যারা আক্রান্ত আছেন, তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন, সেটা পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত আছে। এ সংক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা ভালোভাবে দিতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে পীরগাছা সদর, পারুল, ছাওলা, তাম্বুলপুর ইউনিয়নের বাসিন্দাদের দাবি, গত দুই মাসে অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়ে অন্তত এক হাজার গবাদিপশু মারা গেছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবু ছাইদ বলেন, জেলায় ১৩ লাখের বেশি গরু, ছাগল ও ভেড়া রয়েছে। গত ২৬ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত পীরগাছা, কাউনিয়া, মিঠাপুকুর ও রংপুর সদরে ১ লাখ ৬৫ হাজার গবাদিপশুকে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধী টিকা দেওয়া হয়েছে।
চিকিৎসকদের মতে, অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গবাদিপশুর শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, মাংস, হাড় বা নাড়িভুঁড়ির সংস্পর্শে এলে মানুষ এ রোগে সংক্রমিত হতে পারে। তাই আক্রান্ত পশুর মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু বাস্তবে রংপুর বিভাগজুড়ে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজারের বেশি পশু জবাই হলেও কোথাও সেগুলোর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় না। বিভাগের ১ হাজার ৩০৩টি হাট-বাজারের কোথাও আধুনিক কসাইখানা বা ভেটেরিনারি সার্জনের উপস্থিতি নেই। আইন অনুযায়ী পশু জবাইয়ের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও তা মানা হচ্ছে না। ফলে রোগাক্রান্ত পশুর মাংস সরাসরি মানুষের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে, যা জনস্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশকে একসঙ্গে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলছে।
রংপুর বিভাগের প্রাণিসম্পদ দপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক ডা. মো. আব্দুল হাই সরকার বলেন, প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে মাংস ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স নিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার চেষ্টা থাকলেও জনবল সংকটের কারণে প্রতিটি হাটে চিকিৎসক পাঠানো সম্ভব হয় না। তারপরও স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
মন্তব্য করুন