

রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি হলে হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ে, এ কথা এখন আর নতুন নয়। এ অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ ও জীবনযাপনে পরিবর্তনের পাশাপাশি কিছু প্রাকৃতিক সাপ্লিমেন্ট কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, এসব সাপ্লিমেন্ট কখনোই চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধ বা স্বাস্থ্যকর জীবনধারার বিকল্প নয়।
চলুন জেনে নেওয়া যাক, উচ্চ কোলেস্টেরল কমাতে সহায়ক এমন ১০টি সাপ্লিমেন্ট সম্পর্কে—
১. প্ল্যান্ট স্টেরল ও স্ট্যানল
প্ল্যান্ট স্টেরল ও স্ট্যানল হলো উদ্ভিদজাত প্রাকৃতিক উপাদান, যার গঠন কোলেস্টেরলের মতো। এ কারণে এগুলো হজমপ্রক্রিয়ায় কোলেস্টেরলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এবং রক্তে কোলেস্টেরল শোষণ কমাতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ২ গ্রাম প্ল্যান্ট স্টেরল বা স্ট্যানল গ্রহণ করলে কোলেস্টেরল ৭-১০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।
যেসব খাবারে পাওয়া যায়
ভেজিটেবল অয়েল
নির্দিষ্ট ধরনের মার্জারিন
ব্রেড
সিরিয়াল
এগুলো সাপ্লিমেন্ট হিসেবেও পাওয়া যায়। সাধারণত নিরাপদ হলেও গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী নারীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করা উচিত নয়।
২. সলিউবল ফাইবার (ওট বিটা-গ্লুকান, সাইলিয়াম)
সলিউবল ফাইবার পানিতে গলে জেলির মতো তৈরি হয়। এটি অন্ত্রে বাইল অ্যাসিডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তা শরীর থেকে বের করে দেয়, ফলে কোলেস্টেরল শোষণ কমে। প্রতিদিন অন্তত ৩ গ্রাম ওট বিটা-গ্লুকান অথবা ১০ গ্রাম সাইলিয়াম ফাইবার গ্রহণ করলে এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরল’ কমতে পারে।
সলিউবল ফাইবারের উৎস
সম্পূর্ণ শস্যজাত খাবার
আপেল, কমলা, নাশপাতি, কলা
ডাল, ছোলা, মসুর ডাল
৩. রেড ইস্ট রাইস
রেড ইস্ট রাইস হলো ফারমেন্টেড চাল, যাতে প্রাকৃতিকভাবে মোনাকোলিন কে থাকে—যার গঠন প্রেসক্রিপশন ওষুধ লোভাস্ট্যাটিনের মতো। এটি লিভারে কোলেস্টেরল উৎপাদনের একটি এনজাইম বন্ধ করে কাজ করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এটি এলডিএল কোলেস্টেরল ১৫-২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে।
কিছু সতর্কতা
ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট হিসেবে পাওয়া যায়, তবে মান ভিন্ন হতে পারে
স্ট্যাটিনের মতোই পেশির ব্যথা বা লিভারের সমস্যা হতে পারে
যারা স্ট্যাটিন গ্রহণ করছেন বা লিভারের রোগ আছে, তারা এটি ব্যবহার করবেন না
৪. বারবেরিন
বারবেরিন একটি প্রাকৃতিক যৌগ, যা গোল্ডেনসিল ও বারবেরি গাছে পাওয়া যায়। এটি AMPK এনজাইম সক্রিয় করে, যা চর্বি বিপাক ও এলডিএল কোলেস্টেরল অপসারণে সাহায্য করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বারবেরিন ট্রাইগ্লিসারাইড ২৫–৫৫ mg/dL এবং এলডিএল ২০-৫০ mg/dL পর্যন্ত কমাতে পারে।
প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১,৫০০ মিলিগ্রাম, ছয় মাস পর্যন্ত নিরাপদ বলে গবেষণায় উল্লেখ রয়েছে। তবে কারও কারও হালকা গ্যাস্ট্রিক সমস্যা হতে পারে।
৫. রসুন
রসুনে থাকা অ্যালিসিন লিভারে কোলেস্টেরল উৎপাদন কমাতে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, রসুন সাপ্লিমেন্ট এলডিএল কোলেস্টেরল প্রায় ১০ mg/dL পর্যন্ত কমাতে পারে।
রসুন খাওয়া যায়
এজড গার্লিক এক্সট্র্যাক্ট
গার্লিক অয়েল
কাঁচা রসুন
তবে অতিরিক্ত গ্রহণে পেটের সমস্যা, মুখে দুর্গন্ধ ও রক্ত পাতলা করার ওষুধের সঙ্গে পারস্পরিক প্রভাব পড়তে পারে।
৬. ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (ফিশ অয়েল)
EPA ও DHA নামের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড লিভারে ট্রাইগ্লিসারাইড উৎপাদন কমায় এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL) সামান্য বাড়াতে পারে।
প্রতিদিন ২–৪ গ্রাম EPA/DHA গ্রহণ করলে ট্রাইগ্লিসারাইড ৩০ শতাংশ বা তার বেশি কমতে পারে।
ফিশ অয়েল সাধারণত নিরাপদ, তবে বেশি মাত্রায় রক্ত পাতলা হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
৭. কোএনজাইম Q10 (CoQ10)
CoQ10 একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীরের কোষে শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করে এবং হৃদ্স্বাস্থ্যে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এটি মোট কোলেস্টেরল, এলডিএল ও ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে এবং HDL বাড়াতে সহায়তা করতে পারে।
সাধারণত নিরাপদ, তবে কারও কারও ঘুমের সমস্যা বা পেটের অস্বস্তি হতে পারে।
৮. সিট্রাস বার্গামট
দক্ষিণ ইতালির একটি ফল হলো সিট্রাস বার্গামট। এতে থাকা পলিফেনল ও ফ্ল্যাভোনয়েড লিভারে কোলেস্টেরল সংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে।
এটি এলডিএল ও ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে সহায়ক হতে পারে। স্বল্পমেয়াদে নিরাপদ হলেও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের তথ্য এখনো সীমিত।
৯. সয় প্রোটিন
সয়াবিন থেকে পাওয়া সয় প্রোটিনে থাকা আইসোফ্ল্যাভোন ও বিশেষ পেপটাইড কোলেস্টেরল বিপাক উন্নত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ২৫ গ্রাম সয় প্রোটিন গ্রহণ করলে এলডিএল কোলেস্টেরল ৩-৪ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। সয় সাধারণত নিরাপদ হলেও হরমোন-সংবেদনশীল রোগে ভোগা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।
১০. গ্রিন টি এক্সট্র্যাক্ট (EGCG)
গ্রিন টি এক্সট্র্যাক্টে থাকা EGCG একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি অন্ত্রে কোলেস্টেরল শোষণ কমাতে এবং চর্বি বিপাক উন্নত করতে সহায়তা করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত গ্রহণে এলডিএল কোলেস্টেরল সামান্য কমতে পারে। তবে অতিরিক্ত মাত্রায় লিভারের সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
সাপ্লিমেন্ট শুরু করার আগে যা জানা জরুরি
যেকোনো সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন—বিশেষ করে যদি আপনি নিয়মিত ওষুধ খান বা অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা থাকে। সাপ্লিমেন্ট কখনোই হৃদ্স্বাস্থ্যবান্ধব খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ও চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধের বিকল্প নয়, বরং সহায়ক মাত্র।
সূত্র : ভেরি ওয়েল হেলথ
মন্তব্য করুন