একসময় উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর রংপুর অঞ্চল অত্যন্ত দারিদ্র্যপীড়িত ছিল। তখন এই অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। বিভিন্ন জরিপ প্রতিবেদনে মিলত এমন তথ্য। অধিকাংশই কৃষি শ্রমিক হওয়ায় আশ্বিন-কার্তিক মাস এলেই হাজার হাজার পরিবার কাজের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হতো। নিজের ও পরিবারের জীবন বাঁচাতে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি অল্প দামে বিক্রি করে দিয়ে হতো সর্বস্বান্ত।
আশ্বিন-কার্তিক মাসের বিপর্যস্ত অবস্থার কারণেই মূলত উত্তরবঙ্গকে মঙ্গা এলাকা হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। তবে গ্রামীণ অর্থনীতি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে সে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। জায়গা পরিবর্তন হচ্ছে দারিদ্র্যের। ২০১৬ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা উত্তরবঙ্গকে ছেড়ে দক্ষিণবঙ্গে ঝুঁকছে দারিদ্র্য। বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গের বরিশাল বিভাগে কয়েক বছর ধরে দারিদ্র্যের হার তুলনামূলক বেশি। বর্তমানে দারিদ্র্য এবং অতিদারিদ্র্য মানুষের বসবাস সবচেয়ে বেশি বরিশালে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই মূলত দারিদ্র্যের জায়গা পরিবর্তন হচ্ছে। এ ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং মঙ্গা প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগের কারণে উত্তরবঙ্গে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমছে। একই সঙ্গে বরিশাল অঞ্চলটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দারিদ্র্যবিমোচনে বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি সরকারের সহায়তাগুলো বণ্টন ও পরিকল্পনা করার পরামর্শ তাদের, যাতে ক্ষতিগ্রস্তরা বঞ্চিত না হন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০২২’-এর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে জাতীয় দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর ২০১০ সালে এই হার ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। মৌলিক চাহিদা পূরণ করার মতো আয় যারা করতে পারে না, তারা দরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। মৌলিক চাহিদা পূরণ করে- এমন ভোগ্যপণ্যের একটি তালিকার ভিত্তিতে বিবিএস জরিপ করে থাকে। বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী, দিনে ১ দশমিক ৯০ ডলারের কম আয়ের মানুষকে দরিদ্র বলা হয়।
বিবিএসের জরিপ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বর্তমানে বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি। গ্রামীণ বা শহরের দারিদ্র্যেও ভালো অবস্থানে নেই বরিশাল। এ বিভাগে মোট জনসংখ্যার ২৬ দশমিক ৯ শতাংশই দরিদ্র, যা জাতীয় হারের চেয়ে অনেক বেশি।
অতিদরিদ্র মানুষের বসবাসের দিক থেকেও বরিশাল বিভাগ এগিয়ে। দেশে বর্তমানে এই বিভাগে সবচেয়ে দরিদ্র মানুষ বসবাস করে। বিবিএসের প্রতিবেদন বলছে, দেশে বর্তমানে অতিদরিদ্রের জাতীয় হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সেখানে বরিশাল বিভাগের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ অতিদরিদ্র। সেই হিসাবে বরিশালের অতিদরিদ্রের হার দেশের গড় দারিদ্র্যের হারের দ্বিগুণেরও বেশি।
এর আগের দুই জরিপ (২০১০ ও ২০১৬) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র মানুষের বসবাস ছিল রংপুর বিভাগে। কিন্তু গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে এ দুই স্তরে অনেক উন্নতি করেছে রংপুর বিভাগ। পাঁচ বছরে রংপুর বিভাগে দরিদ্র মানুষের হার কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এলেও বেড়েছে বরিশালে। এ সময়ে বরিশাল বিভাগে মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হয়েছে।
গ্রামীণ দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র মানুষের বসবাসও সবচেয়ে বেশি বরিশালে। যথাক্রমে ২৮ দশমিক ৪ এবং ১৩ দশমিক ১ শতাংশ গ্রামীণ দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষ বরিশালে বসবাস করে। এক্ষেত্রে রংপুর বিভাগে গ্রামীণ দারিদ্র্য ২৩ দশমিক ৬ আর ১০ দশমিক ৩ শতাংশ অতিদরিদ্রের বাস। গ্রামীণ দারিদ্র্য এবং অতিদারিদ্র্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে যথাক্রমে খুলনা ও ঢাকা।
দারিদ্র্যের জায়গা পরিবর্তনের বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণবঙ্গ বড় রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে বরিশাল অঞ্চলটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকায় সবসময় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মূলত এ কারণে দক্ষিণবঙ্গে দারিদ্র্য বাড়ছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে জমিতে লবণাক্ততা বাড়ছে, কৃষি উৎপাদন কমছে। বিভিন্ন সময় বড় বড় দুর্ঘটনায় লাখ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এলাকার কৃষি উৎপাদন কম হওয়া এবং ঘরবাড়ি হারানোর কারণে এসব এলাকার মানুষ বেশি দরিদ্র হয়।
পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক সতর্ক করে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও বাড়বে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ করা মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাঁধগুলো শক্তিশালী করতে হবে, যাতে না ভেঙে যায়। লবণাক্ততা দূর করার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। বাড়িঘরগুলোকে ভালো করতে হবে।
রংপুরে দরিদ্র কমার কারণ হিসেবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, একসময় মঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কারণে উত্তরবঙ্গে দরিদ্র মানুষ বেশি ছিল; কিন্তু মঙ্গা প্রতিরোধে সরকারের কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণের ফলে মঙ্গা আর নেই। এ ছাড়া যমুনা সেতুসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের ফলে অনেকে মাইগ্রেশন করেছে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। অনেকে এখন গ্রাম থেকে উঠে এসে শহরে বিভিন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ খুঁজছে, কাজ করছে। এসব কারণে ওই এলাকার দরিদ্র কমেছে। এগুলোই মূলত রংপুর বিভাগে দরিদ্র কমার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করছে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সভাপতি কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ কালবেলাকে বলেন, উত্তরবঙ্গে দরিদ্রের হার বেশি ছিল। এ কারণে হয়তো ওই দিকে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন সহায়তা কর্মসূচির পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সেটিই করবে। সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির পাশাপাশি পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনও উত্তরবঙ্গের দারিদ্র্যবিমোচনে কাজ করেছে বেশি। সেখানকার মানুষও তৎপর হয়েছে।
খলীকুজ্জমান বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে যে কোনো এলাকা পিছিয়ে যেতে পারে। দক্ষিণবঙ্গের দিকে বিশেষ করে বরিশালের দিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিঘাতটা একটু বেশিই থাকে। ক্ষতিটাও বেশি হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে অবকাঠামো এবং ফসলের ক্ষতি হয়। এ ছাড়া অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ক্ষতির কারণে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দরিদ্র বাড়লে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বাড়বে। সেই হিসাবে হয়তো বরিশালে দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র মানুষের হার বেশি।
বিবিএসের জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দেশে জাতীয়ভাবে অতিদরিদ্রের গড় হার কমেছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। সেখানে বরিশালে কমেছে মাত্র ৩ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও গত পাঁচ বছরে রংপুরে অতিদরিদ্রের হার ৩০ দশমিক ৫ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশে। এই হিসাবেও রংপুর বরিশাল থেকে ভালো অবস্থায় রয়েছে।
২০১০ সালে রংপুর বিভাগে দারিদ্র্য ছিল ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ। সেটি ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ দশমিক ২ শতাংশে। কিন্তু ২০২২ সালে উল্লেখযোগ্য হারে কমে দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১০ সালে বরিশালে ছিল ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১৬ সালে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ।
২০১০ সালে রংপুরে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ, ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৫ এবং ২০২২ সালে ২০ শতাংশেরও বেশি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। যদিও জাতীয় হারের থেকে বেশি হলেও বরিশালের থেকে কম। বরিশালে ২০১০ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস ছিল ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ, ২০১৬ সালে কমে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
জাতীয়ভাবে ২০২২ সালে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি কমলেও বরিশালে কমেছে সামান্য। গত পাঁচ বছরে মাত্র ৩ শতাংশ কমে ২০২২ সালে বরিশালে অতিদরিদ্র মানুষের হার দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, যা জাতীয় হার থেকে দ্বিগুণের বেশি।
সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের হার কমলেও বরিশালের পাশাপাশি ঢাকা ও সিলেট বিভাগে বেড়েছে। মূলত গ্রামাঞ্চলে উচ্চ দারিদ্র্যের কারণে এই তিনটি বিভাগে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঢাকায় দারিদ্র্যের হার বাড়ার মূল কারণ হলো বেশিরভাগ হতদরিদ্র এবং দরিদ্র শহরে চলে আসে এবং বস্তি এলাকায় বসবাস করে। সে কারণে ঢাকায় দরিদ্র বাড়তেই পারে। আর সিলেটে হয়তো হাওর এবং সুনামগঞ্জ এলাকার নদীভাঙনের কারণে হতে পারে।
অন্যদিকে, দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম খুলনা বিভাগে। এ বিভাগে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। এর পরেই অবস্থান চট্টগ্রাম বিভাগের। এই বিভাগের ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। আর অতিদরিদ্রের হিসাবে ঢাকার অবস্থান সবচেয়ে ভালো। মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ অতিদরিদ্রের বাস এ বিভাগে। গ্রামীণ অতিদরিদ্রও ঢাকায় সবচেয়ে কম, মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ।
মন্তব্য করুন