দেশের চার জেলায় সীমান্তে একদিনে বাংলাদেশিসহ ৪৩ জনকে পুশইন করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গার ঠাকুরপুর সীমান্তে ৬ জন, লালমনিরহাট জেলার সীমান্তে ৯ জন, মৌলভীবাজারের বড়লেখা সীমান্তে ১২ জন ও পঞ্চগড়ের দুই সীমান্তে ভারতীয়সহ ১৬ জনকে পুশইন করা হয়েছে।
শনিবার (১৪ জুন) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশের এই সীমান্তগুলোতে পুশইনের ঘটনা ঘটেছে। বিস্তারিত প্রতিনিধিদের সংবাদে-
চুয়াডাঙ্গা : দর্শনা থানার ঠাকুরপুর সীমান্ত দিয়ে নারীসহ একই পরিবারের ৬ বাংলাদেশিকে পুশইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। শনিবার (১৪ জুন) ভোরের দিকে ঠাকুরপুর সীমান্তের ৮৭নং মেইন পিলারের কাছ দিয়ে তাদের পুশইন করা হয়। পরে তাদের বিজিবি দর্শনা থানায় সোপর্দ করে।
আটকরা হলেন- কুড়িগ্রাম জেলার মৃত কিতাব আলীর ছেলে শাহাজান (৪০), শাহাজানের স্ত্রী কহিনুর (৩৫), মেয়ে সাবিহা খাতুন (১৮), শারমিন (১৫), সাথী খাতুন (৮) ও ছেলে নাজমুল (১)।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী শাহাজান বলেন, গত ১৯/২০ বছর আগে আমরা কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে গিয়ে বসবাস করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে ভারতীয় লোকজন আমাদের জোরপূর্বক তাড়িয়ে দিচ্ছে। তারা বলছেন কোনো বাংলাদেশি লোক ভারতে থাকবে না।
এ বিষয়ে দর্শনা থানার ওসি শহীদ তিতুমীর বলেন, বিজিবি আমাদের কাছে একই পরিবারের ৬ জনকে হস্তান্তর করেছে। আমরা তাদের কাছে শুনে তাদের আত্মীয়স্বজনকে খবর দিয়ে কুড়িগ্রাম থানায় একটি বার্তা পাঠিয়েছি।
দামুড়হুদা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কেএইচ তাসফিকুর রহমান জানান, দর্শনা থানার ওসি আমাকে জানালে আমি তাদের ৬ জনকে পূর্ব রামনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাখা হয়েছে। দুপুরে তাদের খাবার ও গোসলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারা একই পরিবারের সদস্য। তাদের আত্মীয়স্বজনকে খবর দেওয়া হয়েছে।
লালমনিরহাট : জেলার হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলার তিনটি সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ৯ জনকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া আরও তিনজনকে পুশইন করার চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও স্থানীয়রা।
শনিবার (১৪ জুন) ভোরে পাটগ্রামের শ্রীরামপুর ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া সীমান্ত দিয়ে ৬ জন এবং একই দিন হাতীবান্ধার সিঙ্গিমারী সীমান্ত দিয়ে ৩ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠায় বিএসএফ।
বিজিবি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পাটগ্রামের ডাঙ্গাপাড়া সীমান্তে প্রধান পিলার ৮৫৩-এর ১ নম্বর উপপিলার সংলগ্ন ভারতের কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ থানার চেঙ্গেরবাড়ী সীমান্ত দিয়ে ভোর সাড়ে ৪টায় ভারতের ১৬৯ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের রতনপুর ক্যাম্পের সদস্যরা ভারতীয় তিন পুরুষ এবং বাংলাদেশি এক নারী ও দুই পুরুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। পরে আজিজপুর গ্রামের কমলার বাজার এলাকায় স্থানীয়রা তাদের দেখে বিজিবিকে খবর দেয়। খবর পেয়ে বিজিবির রংপুর ৬১ ব্যাটালিয়নের (তিস্তা-২) শ্রীরামপুর ক্যাম্পের সদস্যরা গিয়ে তাদের আটক করে।
অন্যদিকে একইদিন ভোরে প্রধান পিলার ৮৯১ ও ৩ নম্বর উপপিলারের সিঙ্গিমারী সীমান্ত দিয়ে ভারতের কোচবিহারের তিলক ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা ৩ জনকে পুশইন করে। এদেরও বিজিবি আটক করে এবং পরবর্তীতে হাতীবান্ধা থানায় হস্তান্তর করে। এছাড়া পাটগ্রামের পূর্ব সারডুবি সীমান্ত দিয়ে আরও তিনজনকে পুশইন করার চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করে বিজিবি ও স্থানীয়রা।
বিষয়টি নিশ্চিত করে শ্রীরামপুর বিজিবি ক্যাম্পের কমান্ডার নায়েব সুবেদার জুবায়ের রহমান জানান, পুশইনের শিকার ব্যক্তিরা আগে ভারতীয় চা বাগানে অবস্থান করছিলেন।
বিজিবি-বিএসএফ উভয়পক্ষই বর্তমানে সীমান্ত এলাকায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, এমন পুশইন ঘটনা বন্ধে দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে তৎপরতা বাড়ানো জরুরি।
মৌলভীবাজার : বড়লেখা সীমান্ত দিয়ে আরও ১২ জনকে পুশইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। শুক্রবার (১৩ জুন) রাত ৯টা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত উপজেলার লাতু সীমান্ত দিয়ে তাদের পুশইন করা হয়। স্থানীয়দের সহযোগিতায় বিজিবি লাতু বিওপির টহল বাহিনী বিএসএফের পুশইন করা ১২ ব্যক্তিকে আটক করেছে।
আটকদের মধ্যে ৭ শিশু, ১ পুরুষ এবং ৪ নারী রয়েছেন। শনিবার (১৪ জুন) বিকেলে বিজিবি-৫২ ব্যাটালিয়ন বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
আটকরা হলেন- সায়েরা খাতুন (৬০), মারিয়া খাতুন (৫০), নূর খাতুন (৩০), মো. তারুক (১৮), মো. রফিক (১২), মো. হোসেন (১০), মো. হারেশ (৭), নূর হাবিবা (০৬), মো. আয়াশ (০৪), সুমিয়া (১০), রমেদা খাতুন (২০), রাশেদা বেগম (৫)। এদের আটক করে পরিচয় শনাক্তের পর থানায় সোপর্দ করে বিজিবি ৫২ ব্যাটালিয়ন। এরা সবাই রোহিঙ্গা মুসলমান।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার রাত ৯টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে উপজেলার লাতু বিজিবি বিওপি এলাকার সীমান্ত দিয়ে অবস্থান নেয় রোহিঙ্গারা। তখন তাদের গতিবিধি সন্দেহ করে স্থানীয়দের সহযোগিতায় বিজিবি আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তারা সবাই কক্সবাজার জেলার উখিয়া থানার বালুখালী শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা। এরা সবাই রোহিঙ্গা মুসলমান।
বিজিবি-৫২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ জানান, বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত দিয়ে অবৈধ বাংলাদেশিদের পুশইন অব্যাহত রেখেছে বিএসএফ। শুক্রবার ভোরে পাল্লাথল বিওপির টহল দল সীমান্ত এলাকা থেকে ১৩ জন ও মধ্যরাতে ১২ জনকে আটক করেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তারা সবাই কক্সবাজার জেলার উখিয়া থানার বালুখালী শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা। শরণার্থী ক্যাম্পের সাথে আমাদের যোগাযোগ প্রক্রিয়া হয়েছে। যাছাই-বাছাই করে শনাক্ত হওয়ার পর তাদের আজ সকালে সংশ্লিষ্ট থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।
বড়লেখা থানার ওসি আবুল কাশেম সরকার জানান, আটক ব্যক্তিরা সবাই কক্সবাজার জেলার বাসিন্দা। তারা সবাই বালুখালী শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা। বিএসএফ তাদের অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক নিয়ম ভঙ্গের শামিল। আটকদের ব্যাপারে যথাযথ প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হবে।
পঞ্চগড় : পৃথক দুই সীমান্ত দিয়ে ৪ ভারতীয় নাগরিকসহ আবারও ১৬ জনকে পুশইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। শনিবার (১৪ জুন) ভোরে সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নের মিস্ত্রি পাড়া ও তেতুঁলিয়া উপজেলার পেদিয়াগছ সীমান্ত দিয়ে তাদের পুশইন করা হয়।
বিজিবি সূত্র জানায়, শনিবার ভোরে পঞ্চগড় ১৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের আওতাধীন মিস্ত্রিপাড়া সীমান্তের মেইন পিলার ৪২১ দিয়ে ভারতের ১৩২ ব্যাটালিয়নের ইশানগঞ্জ ক্যাম্পের সদস্যরা ১১ জনকে পুশইন করেছে। তাদের মধ্যে ৭ জন বাংলাদেশি ও ৪ জন ভারতীয় নাগরিক। এর মধ্যে পুরুষ ৪ জন, নারী ৩ জন এবং শিশু ৪ জন। সকালে তাদের মাগুড়া ইউনিয়নের রজলী থেকে আটক করে বিজিবি।
এদিকে, কাছাকাছি সময়ে পঞ্চগড় ১৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের আওতাধীন পেদিয়াগছ সীমান্তের মেইন পিলার ৪৩২ এর ১নং সাব পিলার এলাকা দিয়ে ভারতের ১৩২ ব্যাটালিয়নের পুরোহিতগছ ক্যাম্পের সদস্যরা ৫ জনকে পুশইন করে। পরে পেদিয়াগছ সীমান্ত এলাকা থেকে আটক করে বিজিবি। তারা বর্তমানে বিজিবির হেফাজতে আছেন।
পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর আইনি প্রক্রিয়া শেষে বাংলাদেশি নাগরিকদের পরিবারের কাছে ও ভারতীয় নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে বিজিবি।
পঞ্চগড় ১৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মনিরুল ইসলাম বলেন, ভোরের দিকে দুই সীমান্ত দিয়ে ১৬ জনকে পুশইন করে বিএসএফ। বিজিবির পক্ষ থেকে তাদের আটক করে থানায় হস্তান্তর করা হয়। বাংলাদেশি নাগরিক ১২ জনের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে। বাকি চারজন ভারতীয় নাগরিক বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদেরকে ভারতে ফেরত দিতে পতাকা বৈঠকের আহ্বান করা হয়েছে। বিএসএফ কর্তৃক তাদের ভারতীয় হিসেবে পরিচয় নিশ্চিত করার পর ফেরত পাঠানো হবে।
মন্তব্য করুন