৮ দফা দেশের ৮ শতাংশ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রত্যেকের মনের কথা উল্লেখ করে সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলন জানিয়েছে, বিগত ৫৩ বছরে কোনো সরকারই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। তাই সংখ্যালঘুদের আগামী দিনের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় অবিলম্বে ৮ দফার বাস্তবায়ন করতে হবে। দাবি আদায়ের অংশ হিসেবে আগামী ২২ আগস্ট ঢাকায় ‘জাতীয় সংখ্যালঘু সম্মেলন-২০২৫’ আয়োজন করা হবে।
শুক্রবার (১ আগস্ট) সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘অভ্যুত্থান পরবর্তী এক বছরে ৮% জনগোষ্ঠীর অবস্থা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি ও মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) তরুণ রায় এ কথা জানিয়েছেন।
‘জাতীয় সংখ্যালঘু সম্মেলনে’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে লিখিত বক্তব্যে জানানো হয়, সম্মেলনে গত ৫৪ বছরের (১৯৭১-বর্তমান) সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হবে। যেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ৮ দফা দাবি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা সবাই উপলব্ধি করতে পারে।
সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনসহ কোনো সংস্কার কমিশনে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি দেখা যায়নি। তাদের প্রশ্ন, ঐকমত্য কমিশনে কোনো রাজনৈতিক দলকেও প্রশ্ন করতে দেখা গেল না যে, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৮ শতাংশ জনগোষ্ঠীর কোনো প্রতিনিধি না থাকলে বা তাদের বাদ দিয়ে কীভাবে ঐক্য গঠন হয়।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, গণঅভ্যুত্থানের আগে হোক বা পরে, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এখনো ৮ শতাংশ শুধু রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার জায়গা। তাদের অধিকার নিয়ে সচেষ্ট হতে দেখা যাচ্ছে না কোনো রাজনৈতিক দলকে। সে ক্ষেত্রে এমন অবস্থা চলমান থাকলে ৮ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে ভবিষ্যতে নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্র বয়কটের সিদ্ধান্তও নিতে হতে পারে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে বলা হয়, গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা আক্রান্ত হতে থাকেন। সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের সূত্র অনুযায়ী, সারাদেশের প্রায় ৩৫টি জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার, লুটপাট, হত্যা, নারীর শ্লীলতাহানি, প্রতিমা ভাঙচুর, মন্দির ভাঙচুর, গীর্জায় হামলা, বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে গত বছরের ৯ আগস্ট থেকে সংখ্যালঘুরা আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই আন্দোলন থেকে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনসহ ৮ দফা দাবি তোলা হয়। সেসব দাবি বাস্তবায়নে তখন অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। কিন্তু গত ১ বছরে ৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের আশানুরূপ কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, সম্প্রতি দেখা গেছে, জুলাই-২৪ আন্দোলনের প্রথম সারির নেতারা, যারা বর্তমানে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, তারা অভ্যুত্থানের বর্ষপূতিকে কেন্দ্র করে জুলাই পদযাত্রা করেছেন এবং বিভিন্ন জেলায় জুলাই আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তবে দুঃখজনকভাবে তারা সংখ্যালঘু ৯ শহীদের কোনো পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বলে দৃশ্যমান হয়নি। এমন বৈষম্যমূলক আচরণ আমাদের আরও হতাশায় ফেলেছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সংগঠক ও মুখপাত্র সুস্মিতা কর বলেন, সরকারের ঐকমত্য কমিশনে সংখ্যালঘু প্রতিনিধি নেই। দেশের একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে নিয়ে তো ঐকমত্য গঠন হতে পারে না। গত বছরের ৯ আগস্ট থেকে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেষ্ট আছে। সংখ্যালঘুদের সব সংগঠন আট দফা দাবিতে একাত্ম। যার ফলে ৮ দফা হয়ে উঠেছে ৮% জনগোষ্ঠীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের সনদ। যদি নির্বাচনপূর্ববর্তী সময়ে সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো থেকে এসব দাবি বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে না দেখা যায়, তাহলে হয়তো সংখ্যালঘুরা ভোট বয়কট লড়তে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের পক্ষ থেকে পুনরায় ‘সংশোধিত ও চূড়ান্ত’ ৮ দফা তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো :
১. (ক) ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করতে হবে। (খ) ‘বৈষম্য বিলোপ আইন’ প্রণয়ন করতে হবে।
২. ‘সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ গঠন করতে হবে; তার পূর্বে (ক) ‘সংখ্যালঘু কমিশন’ গঠন করতে হবে ও বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সাম্প্রদায়িক হামলার তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি প্রদান এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন করতে হবে। (খ) আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩. গণপরিষদের নির্বাচনে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা অথবা জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সরকারে, সংসদে, জনপ্রতিনিধিত্বশীল সকল সংস্থায় অংশীদারিত্ব ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
৪. হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে ‘হিন্দু ফাউন্ডেশনে’, বৌদ্ধধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে ‘বৌদ্ধ ফাউন্ডেশনে’ এবং খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে ‘খ্রিস্টান ফাউন্ডেশনে’ উন্নীত করতে হবে।
৫. (ক) দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। (খ) হরিজন, দলিত, তেলেগু, চা-শ্রমিকদের বাসস্থান তাদের নামে স্থায়ী বরাদ্দ করতে হবে। (গ) পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি কমপক্ষে ৮০০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে।
৬. (ক) সরকারি/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য উপাসনালয় নির্মাণ এবং প্রতিটি হোস্টেলে প্রার্থনা কক্ষ বরাদ্দ করতে হবে। (খ) সংবিধানের ২৯(৩)(ক) অনুচ্ছেদের আলোকে তফসিলি সম্প্রদায়ের জন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
৭. (ক) সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড আধুনিকায়ন করতে হবে। (খ) আদিবাসীসহ সকল ভাষাভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও বিকাশের উদ্যোগ নিতে হবে।
৮. শারদীয় দুর্গাপূজায় ৫ দিন, ইস্টার সানডে ১ দিন, প্রবারণা পূর্ণিমায় ১ দিন এবং বৈসাবিতে ১ দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করতে হবে।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সংগঠক সুব্রত বল্লভ, কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি ও মুখ্য সংগঠক (আদিবাসী সম্প্রদায়) সুমন ত্রিপুরা।
মন্তব্য করুন