ইংরেজি ‘রেফারেন্ডাম’–এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো ‘গণভোট’। সংস্কারের উদ্যোগে সারা দেশে এখন আলোচনায় গণভোট। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে জনগণ সরাসরি ভোট দিয়ে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের মতামত দেয়। গণভোট মূলত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমত যাচাইয়ের জন্য গণভোটকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ধরা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সংবিধান সংশোধন, আইন তৈরি, রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা, এমনকি শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রেও গণভোটের আয়োজন করা হয়। ব্যালটে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ ভোটের মাধ্যমে গণভোট নেওয়া হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নানা রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ছিল প্রশাসনিক গণভোট এবং আরেকটি সাংবিধানিক গণভোট। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৭ সালে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয় গণভোট হয়েছিল রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৫ সালে। সবশেষ গণভোট ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর হয়েছিল।
যে কারণে গণভোট হয়েছিল
১. প্রথম গণভোট হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৩০ মে। উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনের বৈধতা যাচাই।
ওই বছরের ৩১ মে দৈনিক ইত্তেফাকের খবর থেকে জানা যায়, সারা দেশে ২১ হাজার ৬৮৫টি কেন্দ্রে ৩০ মে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোট নেওয়া হয়। ওই সময় দেশে মোট ভোটার ছিলেন ৩ কোটি ৮৪ লাখ।
সেই গণভোটে ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে ‘না’ ভোট পড়েছিল ১ দশমিক ১ শতাংশ।
২. দ্বিতীয় গণভোট হয়েছিল ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ। উদ্দেশ্য ছিল এরশাদের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে জনসমর্থন যাচাই। জনগণের আস্থা থাকলে জেনারেল এরশাদের ছবিসহ ‘হ্যাঁ’ বাক্সে এবং আস্থা না থাকলে ‘না’ বাক্সে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, সেই গণভোটে ৭২ দশমিক ২ শতাংশ ভোটার উপস্থিত ছিল। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট ছিল ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ‘না’ ভোট ছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
৩. গণ-আন্দোলনে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ। এর ৩ মাসের মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি। ১৬ বছরের রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা থেকে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সংসদীয় পদ্ধতির (পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি) সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট মধ্যরাতে সর্বসম্মতিক্রমে সংসদে বিল পাস হয়।
ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ‘তিন জোটের রূপরেখা’ অনুযায়ী জাতীয় সংসদে গৃহীত সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার পর সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে থাকা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সম্মতি দেবেন কি না, সে প্রশ্নে দেশব্যাপী গণভোট আয়োজনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
দেশের ইতিহাসে অনুষ্ঠিত সেই তৃতীয় গণভোটে ভোট পড়ে ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ। ১ কোটি ৮৩ লাখ ৮ হাজার ৩৭৭ জন ভোটার সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে, অর্থাৎ ‘হ্যাঁ’ ভোট দেন। এই হার ৮৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে ৩৩ লাখ ৯০ হাজার ৬২ জন ভোটার ‘না’ ভোট দেন। অর্থাৎ তারা রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। ‘না’ ভোটের হার ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। গণভোটে ৯৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বৈধ ভোটের বিপরীতে বাতিল হয়েছিল শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ ভোটা।
আসন্ন গণভোটের প্রেক্ষাপট
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারায় সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়াকে জনসমর্থন দিতে নতুন করে গণভোট আয়োজনের পরিকল্পনা সামনে এসেছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই এবার গণভোটের লক্ষ্য।
তবে এটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হবে, না পরে; নাকি একসঙ্গে আয়োজন করা হবে—এই বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। দৈনিক প্রথম আলোতে সোমবার (১৩ অক্টোবর) এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে।
মন্তব্য করুন