আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িকতা দূর করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলেছেন, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম যেমনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে না, তেমনি সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। নতুন ভোটারদের এসব ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত করানোর তাগিদ দিয়ে তারা বলেন, কওমি মাদ্রাসা থেকে শুরু করে সব রকমের শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ্যবইতে মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরার মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে তোলা সম্ভব। মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সম্প্রীতি বাংলাদেশ আয়োজিত ‘সম্প্রীতির বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার ঠাঁই নাই’- শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা এসব মতামত তুলে ধরেন।
বক্তারা বলেন, আগামীতে সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতায় আসলে দেশের সম্প্রীতি আরও নষ্ট হবে। তাই এ ব্যাপারে সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির অনৈক্য ও স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে সাধারণ মানুষকে দেশবিরোধী শক্তি সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
মুখ্য আলোচক হিসেবে অংশ নিয়ে বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘটনার মধ্য দিয়ে পেছনে ঠেলে দেওয়া দেশকে সামনে আসতে এখনও যুদ্ধ করতে হচ্ছে। রক্ত যদি মূল্যবান হয়ে থাকে তবে বাংলাদেশের মতো রক্তের মূল্য দিয়ে কেউ স্বাধীনতা কেনেনি। তাই তরুণ প্রজন্মকে স্বাধীনতার ইতিহাস জানাতে হবে। নতুন ভোটারদের কাছে সাম্প্রদায়িকতার ভয়ংকর ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। পাঠ্যবইতে অসাম্প্রদায়িকতা যুক্ত করলে নতুন প্রজন্মকে সুনাগরিক গড়ে তোলা সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসার প্রায় ৩৫ লাখ শিশুকে সাম্প্রদায়িক শিক্ষা থেকে রক্ষা করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘ভূতের বাচ্চা সোলায়মান’ বইটি লেখার কারণে আমার ওপর হামলা হয়েছিল। সুস্থ হয়ে জেলখানায় হামলাকারী তরুণের সঙ্গে সাক্ষাতে হামলার কারণ জানতে চাই। সে অকপটে স্বীকার করে, আমি না কি নাস্তিক। এরকমভাবে মগজধোলাই করে আমার ওপর হামলা করানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের সন্তানদের কাছে দেশের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরে সত্যিকারের মগজধোলাই করতে ব্যর্থ হচ্ছি।
সরকারের একটা বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আটকে যাবে একথা উল্লেখ করে বরেণ্য এই শিক্ষাবীদ বলেন, হেফাজতের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার পাঠ্যপুস্তক থেকে অমুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ লেখা বাদ দিয়েছিল। এনসিটিবিসহ কোনো পক্ষই এর সদুত্তর দিতে পারেনি।
রাজাকারদের মন্ত্রী বানানোর মতো ভুল আর করা যাবে না বলে তরুণ প্রজন্মকে সাবধান করে তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মকে সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুশাসন শিক্ষা দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা ভেবেছিলাম, আগের সেই সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানি আর ফিরে আসবে না। কিন্তু কিছুদিন পরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করল, মুক্তিযুদ্ধে কি এত মানুষ মারা গেছে? রাজাকারদের গাড়িতে মন্ত্রীর পতাকা তুলে দেওয়া হলো। আমাদের আর এমন ভুল করা চলবে না।
তিনি বলেন, আমি আশাবাদী মানুষ। আমি বিশ্বাস করি, সাধারণ মানুষদের ব্যবহার করে খারাপ জায়গায় নেওয়া হচ্ছে। আমরা তাদের ব্যবহার করতে পারছি না। ধর্মকে সম্প্রীতির বাংলাদেশের জন্য কাজে লাগাতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে গ্রামীণ ঐতিহ্যের সংস্কৃতি। যে বাংলাদেশের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা যুক্ত করেছিলেন, সেই দেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।
মানুষের হৃদয়ে সাম্প্রদায়িকতা ও সম্প্রীতি দুটোই আছে উল্লেখ করে অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ’৭১-এর মতো আমরা রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে দাঁড়াতে পারিনি বলে আজকের এই দুঃসময়। পায়ে পায়ে সবাই মিলে ৫২ বছরের সব বাধা সরাতে হবে। সবাই যদি একত্রিত হতে পারি তাহলে ৪৬-৪৭ না ফিরে আমরা জিতব।
সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে না পারলে গণতন্ত্র টেকসই হবে না উল্লেখ করে বরেণ্য এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলেন, অধপতনের শেষ সময়ে আমরা এখনও যাইনি। তৃনমূল মানুষের মধ্যে এখন অসাম্প্রদায়িক চেতনা রয়েছে, তা আরও জাগ্রত করতে হবে। আমরা রাজাকারমুক্ত মুক্তিযুদ্ধের দেশ চাই, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প চাই না।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি প্রশ্ন রেখে ডিবিসি নিউজের সম্পাদক প্রণব সাহা বলেন, নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কতগুলো ’৭২-এর সংবিধানে ফেরার ব্যাপারে একমত হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরতে রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজি করানো যাবে না। ভোটে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনে বিষয়ে নজর রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে হবে একথা উল্লেখ করে সাংবাদিক মোস্তফা হোসেন বলেন, নেতাদের কর্মকাণ্ডের কারণে জামায়াত সুষ্পষ্টভাবে জঙ্গি দল। রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না। সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া সম্প্রীতির বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হবে না বলেও মনে করেন প্রবীণ এই সাংবাদিক।
ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, কখনও ধর্মের নামে কখনও রাজনীতির নামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে। সামনে নির্বাচন। নির্বাচন এলেই আমরা ভয়ে থাকি। নির্বাচনের আগে ও পরে যে সহিংসতা হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার শিকার হয় সংখ্যালঘুরা।
তিনি বলেন, সম্প্রীতি নষ্টের পেছনে রয়েছে মৌলবাদীরা। বিভিন্ন সময় সরকার তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। কোনো সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি, পৃষ্ঠপোষকতাকারী নির্বাচনে এলে পরিবেশ নষ্ট হবে।
দেশে অপশক্তি বেড়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলেন, রাজনৈতিক নেতারা যুবসমাজকে ধ্বংস করছে। ধর্মের নামে হানাহানিতে যুবসমাজকে কাজে লাগানো হচ্ছে। এ জন্য আদর্শিক জায়গায় আমাদের ইস্পাত কঠিন ঐক্য জরুরি।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. ফারজানা মাহবুব বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতার অপব্যাখ্যা দিয়ে যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে।
গোলটেবিল সঞ্চালনা করেন সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল। বক্তব্য রাখেন, সাংবাদিক নূর সাফা জুলহাস, গ্রাম থিয়েটারের যুগ্ম সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না প্রমুখ।
মন্তব্য করুন