বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের (বিএসএমএমইউ) ডক্টরস হলে প্রকাশ্যে মাদক সেবন হচ্ছে- এমন একটি খবর প্রকাশ করে কালবেলা। এরপর ওই হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে মাদক সেবন অবস্থায় দুজনকে আটক করা হয়েছে।
শুক্রবার (২১ জুন) সন্ধ্যার দিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় প্যাথেডিন গ্রহণ করার সময় বাথরুমে হাতেনাতে আটক হয় দুজন। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে শাহবাগ থানায় পাঠানো হবে।
বিএসএমএমইউয়ের হল প্রভোস্ট কালবেলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘হলের বাথরুম থেকে দুজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এই হলে নিরাপত্তাজনিত কারণে বহিরাগতরা প্রবেশ করে। হলে জনবল বৃদ্ধি ও উন্নয়নের বিষয়ে একটি বড় সুপারিশ করা হয়েছে। যাতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড না ঘটে।’
হলে থাকা চিকিৎসকদের দাবি, আটক দুজনেই বহিরাগত। তাদের আটকের পর হাসপাতালে আনসার সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বিএসএমএমইউয়ের আনসার কমান্ডার মনির কালবেলাকে বলেন, ‘হলের বাথরুম থেকে দুজনকে আটক করা হয়েছে। তারা হলেন- শুভ ও আব্দুস সামাদ। তাদের শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।’
তারা দুজনেই সেখানে মাদক সেবন করছিলেন বলে জানান তিনি।
এর আগে ডাক্তার ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ‘শরীরে ভয়ঙ্কর মাদক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন কালবেলায় প্রকাশ হয়। এতে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডক্টরস’ হলে প্রকাশ্যেই চলছে এমন মাদক সেবন, শরীরে মাদক গ্রহণ ও নারী নিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ।
খোদ চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ও চিকিৎসক হতে চলা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই জড়িয়ে পড়েছেন ভয়ানক মাদকের জালে। হলে চলা অপকর্ম ঢাকতে বিভিন্ন জায়গায় লাগানো সিসিটিভির সংযোগ খুলে রেখেছেন তারা।
হলের বাথরুম, ছাদসহ একাধিক স্পষ্টে মাদক সেবনের আলামত পাওয়া গেছে। ৭ তলাবিশিষ্ট এই ভবনটিতে প্রবেশের সময়ই চোখে পড়ে দেয়ালে লাগানো সিসিটিভি। কিন্তু সিসিটিভির বিদ্যুৎ সংযোগের ক্যাবলটি খুলে রাখা হয়েছে। একটি নয়, ওই ভবনে থাকা অন্য সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোরও অবস্থা একই।
ভবনটির ৭ম তলায় রয়েছে হলের একটি অফিস কক্ষ। আর অফিস কক্ষের পাশেই কয়েকটি বাথরুম। সেই বাথরুমে প্রবেশের পর চোখে পড়ে ভয়ংকর কিছু জিনিস। বাথরুমের ভেতরে এবং বাইরের ভেন্টিলেটরে শত শত ইনজেকশন ও সিরিঞ্জ পড়ে আছে।
হাসপাতালে ইনজেকশন ও সিরিঞ্জ থাকা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু ডাক্তার ও মেডিকেল স্টুডেন্টের হলের বাথরুমে এত ইনজেকশন ও সিরিঞ্জ কেন? রহস্য জানতে পড়ে থাকা সেখানকার ব্যবহার করা ইনজেকশনগুলো হাতে নিয়ে দেখা যায়, সেগুলো প্যাথেডিনের এবং একই জাতীয় গ্রুপের। মূলত এটি রোগীর অপারেশনের সময় ব্যবহার করা। তবে প্যাথেডিন মাদকসেবীদের কাছে একটি ভয়ানক মাদক।
বিএসএমএমইউয়ের ডক্টরস হলে এত প্যাথেডিন কারা সেবন করেন- জানতে চাইলে সেখানকার এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন করার শর্তে কালবেলার কাছে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘হলে থাকা কিছু মেডিকেল স্টুডেন্ট প্যাথেডিনের নেশায় আসক্ত। এমনকি ওই হলে থাকা এমবিবিএস পাস করা কয়েকজন চিকিৎসকও এমন নেশায় আসক্ত।’
বিএসএমএমইউয়ের ওই কর্মকর্তা জানান, শুধু বাথরুমে নয়, ভবনের ছাদে বসে নিয়মিত মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল সেবন করেন শিক্ষার্থীরা। তার কথার সূত্র ধরে ভবনটির ছাদে গিয়েও একাধিক ফেনসিডিলের খালি বোতল পড়ে থাকতে দেখা যায়। নিয়মিত মদপানের আলামতও মিলেছে সেখানে।
নানারকমের ভয়ের কারণে মুখ খুলতে চান না ডক্টরস হলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। তাদের অভিযোগ, ডক্টরস হলে অবৈধভাবে থাকছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। ছাত্রত্ব শেষ হলেও হল ছাড়েননি অনেক চিকিৎসক। বারবার নোটিশ দেওয়ার পরও কাজ হয়নি কিছুই। হলের সাবেক প্রোভোস্ট অধ্যাপক ডা. আলী আসগর মোড়লও জানান একই কথা।
তিনি বলেন, ‘ওখানে কিছু রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। চাইলেই সবকিছু করা যায় না। আমি যতদিন ছিলাম চেষ্টা করেছি; কিন্তু পুরোপুরি পারিনি। আমি নিচে আনসার মোতায়েনসহ সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে ছিলাম।’
হলের ৭ম তলাতেই চলে অনেক অবৈধ কার্যালকলাপ। সেখানে ডাইনিং হলে অবৈধভাবে একটি দোকানও চলছে বহু বছর ধরে। যার পাশেই চলে নেশার আসর। হলে প্যাথেডিন ও নেশা করেন কারা- জানতে যোগাযোগ করা হয় সেখানে বসবাসকারী একাধিক চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে। অনেকেই হলের ভেতরে নেশা করার অভিযোগের বিষয়টি স্বীকারও করেছেন।
ডক্টরস হলে ৭২২ রুমে বসবাসকারী ডা. শুভ কালবেলাকে বলেন, ‘নেশা করার কিছু ঘটনার অভিযোগ রয়েছে। বিস্তারিত এখন বলতে পারছি না।’
ডক্টরস হলের মধ্যে নেশার দ্রব্য কীভাবে আসে জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি হল সুপার। তার দাবি, নেশার বিষয়টি বর্তমান প্রভোস্টের মাধ্যমে ভিসির কাছে জানানো হয়েছে।
বিএসএমএমইউ হল সুপার আ.র.ম. ওয়ালীউল্লাহ কালবেলাকে বলেন, ‘এসব কিছু কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তারা ব্যবস্থা না নিলে আমরা কী করতে পারি। প্রোভোস্ট স্যারের মাধ্যমে ভিসি স্যারকেও জানানো হয়েছে।’
হলের নিয়ম অনুযায়ী, ছেলেদের হলের ভেতর নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু দেদার নারীদের চলাফেরা রয়েছে বিএসএমএমইউয়ের হলের ভেতরে।
২০২৩ সালের ২০ জুলাই সন্ধ্যায় হলের ৭১৮ নম্বর কক্ষে এক ছাত্র এক নারীকে রুমে নিয়ে এসেছিল। পরে অন্য ছাত্ররা তাদের দেখে রুম আটকে দেয়। এরপর পুলিশ এসে তাদের নিয়ে যায়। এ ঘটনার তদন্তে বিএসএমএমইউর ২৩ জুলাই একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সেই ঘটনার পরেও থামেনি হলে নারীদের হলে নিয়ে আসার কাজ। সরেজমিনে গিয়ে দিনদুপুরে ছাত্রদের হলের ৭ তলায় নারীদের প্রবেশ করতে দেখা গেছে।
ডক্টরস হলের দায়িত্ব নেওয়ার পর হলটির সংস্কারসহ নানা রকমের সুপারিশ করেছেন বর্তমান হল প্রোভোস্ট অধ্যাপক ডা. এসএম মোস্তফা জামান।
তার কাছে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় নোট করে লিখিতভাবে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি এবং একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। হলের সংস্কারসহ নানা রকমের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।’
সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডা. দীন মোহাম্মদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তার ব্যক্তিগত সহকারীর রুমে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও দেখা মেলেনি ভিসির। পরবর্তীতে মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও তা রিসিভ করেননি তিনি। এরপর মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর মেলেনি।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যদি নেশাগ্রস্ত হয় সেটা সমাজের জন্য সবচেয়ে ভয়ানক বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ডা. তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘মানুষ স্রষ্টার পরে ভরসা করে চিকিৎসকের ওপরে। কারণ, চিকিৎসকেরাই একজন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারেন। সেই চিকিৎসকের মধ্যে কেউ যদি নেশাগ্রস্ত হয় তাহলে সেটা সমাজের জন্য ভয়াবহ সমস্যা। চিকিৎসাসেবার সুযোগ নিয়ে কেউ এ ধরনের মাদক গ্রহণ করলে তাদের কাছে থেকে আমরা কতটা নিরাপদ- সেটাই বড় প্রশ্ন।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, প্যাথেডিন একটি ভয়ানক ড্রাগ। অনুমতি ছাড়া এটি উৎপাদন এবং কেনা-বেচা পুরোপুরি নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (গোয়েন্দা ও অপারেশন) তানভীর মমতাজ কালবেলাকে বলেন, ‘প্যাথেডিন একটি ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত মাদক। অনুমতি ছাড়া এটি উৎপাদন, কেনা-বেচা ও গ্রহণ নিষিদ্ধ। কোনো মেডিকেল স্টুডেন্ট বা চিকিৎসক তাদের পেশার সুযোগ নিয়ে এটি ব্যবহার করলে প্রচলিত মাদক আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
যে কোনো পেশার মানুষ প্যাথেডিন সেবন করলে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘সমাজের যে কোনো সেক্টরের মানুষ মাদকে জড়িয়ে গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চিকিৎসক ও মেডিকেল স্টুডেন্টরা যদি সহজলভ্য হওয়ার কারণে প্যাথেডিন গ্রহণ করে এবং পুলিশের অভিযানে আটক হয় তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
মন্তব্য করুন