মহসীন হাবিব
প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:৪২ এএম
আপডেট : ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৩৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

যা আমরা বুঝেও বুঝি না

যা আমরা বুঝেও বুঝি না

বাংলায় একটা কথা প্রচলন আছে, ‘ভাত একটা চাপ দিলেই বোঝা যায় পাতিলের সব ভাত সিদ্ধ হইছে কি না।’ বিশ্বব্যাপী যে ঘটনাবলি চলমান, তার একটি চিত্র তুলে ধরলে বোঝা যাবে গণতন্ত্র কোন পথে চলে, গণতন্ত্রের ব্যবহারিক চেহারা কী, মানবতা সংজ্ঞায়িত যারা করেন, তারা কারা, কী চান! এটি কোনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা নয়, যে কেউ ইন্টারনেট সার্চ করলেই এর সত্যতা জানতে পারেন। এ নিয়ে পত্রিকান্তরে আগেও লিখেছি।

মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকার একটি ছোট্ট দেশ ইকুইটারিয়াল গিনি। উত্তরে ক্যামেরুন, দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে গ্যাবন এবং পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর। মাত্র ২৮ হাজার স্কয়ার কিলোমিটারের দেশটির জনসংখ্যা কমবেশি ১৫ লাখ। হলে কী হবে, দেশটি এককথায় তেলের ওপর ভাসছে। দেশটিতে বর্তমানে প্রতিদিন তিন থেকে চার লাখ ব্যারেল তেল উৎপন্ন হয়! মাথাপিছু আয় (হায়রে পার ক্যাপিটা!) সাড়ে ৮ হাজার ডলার, যা আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ, অথচ দেশটির ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে! কার পেটে যায় এই তেল আর কে শাসন করে দেশটি একটু ধৈর্য সহকারে শুনুন।

১৯৬৮ সালে স্পেনের উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার আগে স্বায়ত্তশাসন প্রক্রিয়া চলার সময় স্পেনীয়রা এক বদ্ধপাগলকে উপপ্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে, যার নাম ছিল ফ্রান্সিসকো ম্যাসিয়াস গিইমা। ভূত বা ডাইনি তাড়ানোর এক ওঝার সন্তান ম্যাসিয়াস। ছোটখাটো কাজ করতেন এবং স্প্যানিশদের ফুটফরমায়েশ খাটতেন। একপর্যায়ে তিনি দোভাষী হন। স্প্যানিশ প্রভুদের আদালতে বিচারকালে দোভাষীর কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে একাধিকবার ঘুষ খেয়ে তিনি ধরাও পড়েন। তিনি নিজে মানসিক রোগী বলে স্বীকার করতেন এবং স্পেনে গিয়েও তিনবার মানসিক রোগের চিকিৎসা করেছেন। কিন্তু তাতে কী, অনুগত তো! স্বাধীন রিপাবলিক অব ইকুইটারিয়াল গিনির প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এই ম্যাসিয়াস স্প্যানিশদের সহায়তায়। তার একটি ভয় ছিল, তাকে কেউ মেরে ফেলবে। সেই ভয় থেকে ক্ষমতায় এসে প্রথম বছরেই ১৫০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই শুরু, এরপর হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেন প্রায় বিনা কারণে। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে নিজেকে দেশটির ‘গড’ দাবি করেন। একপর্যায়ে স্পেন পর্তুগালের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। তিনি নিজেকে মার্ক্সিস্ট দাবি করেন। কিউবা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ব্যস, ১২ বছরের দুঃশাসনের পর তারই ভাতিজা এবং ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান ম্যাসিয়াসের চেয়েও ভয়ংকর থিওডোরো ওবিয়াঙ গিইমা বাসোগো ১৯৭৯ সালে এক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং অবশ্যই পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহায়তায়। একপর্যায়ে ১৯৯৬ সালে দেশটিতে তেল আবিষ্কৃত হয়! সেই তেল উত্তোলনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রের চারটি কোম্পানি—এক্সনমোবিল, ম্যারাথন ওয়েল, কসমস এনার্জি ও শেভরন।

দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত রেডিও ও টেলিভিশনে ওবিয়াঙকেও চাচার মতো ইকুইটারিয়াল গিনির গড বলা হয়েছে একাধিকবার। তিনি এত ক্ষমতার অধিকারী যে, যে কোনো অপরাধীকে মুক্তি দেওয়া এবং যে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য তাকে কোনো জবাবদিহি বা ব্যাখ্যা করতে হয় না। তারপরও যদি দেশের মানুষের জন্য কোনো মায়া-মমতা থাকত, অথবা মানবাধিকার থাকত। আফ্রিকার সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের এ স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ৫০ হাজারের অধিক মানুষ হত্যার অভিযোগ রয়েছে। অসংখ্য নিষ্ঠুর কাহিনি আছে তার, সেগুলো লিখলে দীর্ঘতর হবে নিবন্ধ। তার টাকা-পয়সার কথা বলি। ওবিয়াঙের ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রিগস ব্যাংকে শুধু ৭০০ মিলিয়ন ডলার ডিপোজিট ছিল। এই ব্যাংকে চিলির স্বৈরশাসক এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বন্ধু অগাস্টো পিনোসের অর্থ জমা ছিল। ওবিয়াঙের অর্থ আছে ফ্রান্সে এবং সুইস ব্যাংকে। ২০১০ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকেই ওবিয়াঙের ৭০০ মিলিয়ন নগদ ডলার অর্থ জমা রয়েছে। এটি তার অন্যান্য সম্পদের হিসাব ছাড়া। ওবিয়াঙের একটি প্রাইভেট জেট আছে যার মূল্য ৩৬ মিলিয়ন ডলার। এ প্লেনটি সোনা দিয়ে কারুকাজ করা। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারাথন ওয়েল কোম্পানি একটি জায়গা ক্রয় করতে ওবিয়াঙকে একটি গাড়ি উপহার দিয়েছে, যার মূল্য ২ মিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র তেলের ব্যবসাটাই শুধু নেয় না, ওবিয়াঙের অর্থের শেয়ার নানাভাবে আদায় করে। মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধে তার কাছ থেকে ২৫ মিলিয়ন ডলার আদায় করা হয়েছে। ওবিয়াঙের দুই ছেলের বিলাসী জীবন ইউরোপীয় ধনীদের কাছে স্বপ্নের মতো। এক ছেলেকে ৭১ মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে হয়েছে ফ্রান্সে। যেভাবে বলছি তাতে মিলিয়ন ডলারকে মনে হচ্ছে ১০০ টাকা বুঝি! যুক্তরাষ্ট্রে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আদালতে উপস্থিত হয় দেশটির বিভিন্ন ব্যাংক, লবি প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সহায়তায় দেশটির ইন্ডিপেনডেন্স ফেডারেল সেভিংস ব্যাংক এগিয়ে এসে সাক্ষ্য দেয়, ‘Equatorial Guinea is a friend of the United States and that the banks help would be appreciated.’

ওবিয়াঙ ৪২ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে আসছেন এবং অধিকাংশ সময় একক প্রার্থী হিসেবে। ১৯৯২, ১৯৯৬ ও ১৯৯৮ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ৯৭ শতাংশ ভোট পেয়ে। ২০০২ সালে নির্বাচিত হওয়ার সময় বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে তিনি ভোট পান ১০৩ শতাংশ! অর্থাৎ ১০০ ভোটের মধ্যে ১০৩ ভোট। ২০০৯ সালে তিনি বিরোধী দলের প্রার্থীর (গৃহপালিত) বিরুদ্ধে ভোট পান ৯৭ শতাংশ। অথচ প্রকৃত অর্থে দেশে তার কোনো ভোট নেই। একাধিক পশ্চিমা সাংবাদিক সেখানে গিয়ে দেখতে পেয়েছেন, গোটা সমাজ ওবিয়াঙের বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে আর তিনি কোটি কোটি ডলার খরচ করেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ল্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের মতো লবিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে। দেশটির আর্মির সংখ্যা ১ হাজার ৪০০ ও পুলিশ ৪০০। কিন্তু তাকে পাহারা দেয় অত্যন্ত উচ্চবেতনের মিশর ও মরক্কোর ভাড়া করা মার্সেনারিরা। ২০০৪ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার সঙ্গে বসে ডিনার করেন। তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট কন্ডোলিৎসা রাইস ওবিয়াঙকে ‘আওয়ার গুড ফ্রেন্ড’ বলে অভিহিত করেছেন।

শুধু ওবামারাই নন, এই গত অক্টোবর মাসে দেশটির ৫৫তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের স্টেটমেন্টে বলা হয়—‘On behalf of the Government of the United States of America, I extend our congratulations to Equatorial Guinea in honor of the 55th anniversary of your independence on October 12. The United States values our relationship with Equatorial Guinea, and we remain committed in our partnership to combat trafficking in persons, develop the initiative on Atlantic Cooperation, and promote maritime security and economic growth. In the coming year, we look forward to Equatorial Guinea advancing its efforts to improve democratic governance and respect for human rights and to grwo our economic and security partnership. As you celebrate another year of independence, we send our wishes for a peaceful and prosperous year for Equatoguineans.’

কী দরদ! কোথায় গণতন্ত্র বসবাস করে ভাই? এত বড় এক দুর্নীতিবাজ, নিষ্ঠুর, স্বৈরশাসক নিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের কোনো বিবৃতি শোনা যায় না কেন? এক দেশে ৫০ হাজার মানুষ হত্যা, সব সম্পদ লুটে নেওয়া কারও বিরুদ্ধে বিবৃতি নেই, আরেক দেশে রাস্তায় একজন অস্বাভাবিক প্রকৃতির ব্যক্তির সঙ্গে ধস্তাধস্তি (যদিও তা কোনোক্রমেই হওয়া উচিত নয়) নিয়ে বিবৃতি দেওয়া বৈপরীত্যের চরম ঔদ্ধত্য নয় কি? উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে আমাদের বুঝতে কোনোই অসুবিধা হয় না যে, এ মনস্টারকে শান্ত রাখতে দুটো ‘খাবার’ দিতে হয়। একটি তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বাণিজ্য, আরেকটি সমাজতান্ত্রিক ব্লক থেকে দূরে থাকা। তবে আমরা অচিরেই ওবিয়াঙ বিষয়ে অনেক ধরনের কথা শুনতে পাব এবং বৃদ্ধ অবিয়াঙকে হয়তো ক্ষমতার বাইরে দেখতে পাব। কারণ, ওবিয়াঙ ইদানীং চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। আবার সেটা নাও দেখতে হতে পারে। কারণ ওবিয়াঙের বয়স এখন ৮১ বছর। হয়তো অল্পদিনের মধ্যেই তার ছেলেদের কেউ, বিশেষ করে থিওডোরো গিইমা মাঙ্গি ক্ষমতায় আসবেন, যিনি বর্তমানে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। মাঙ্গি পশ্চিমা সমাজে বিভোর। অবশ্য ফ্রান্সে তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা আছে। সে অনেক কথা। তবে এ মামলার রেজাল্ট নির্ভর করবে ভবিষ্যতে তার দেশ সম্পর্কিত নীতি, আচরণ এসবের ওপর। মুশকিল হলো, উন্নয়নশীল দেশের মানুষ হিসেবে এসব আমরা বুঝেও অবুঝ থেকে যাই।

লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাংবাদিককে বেধড়ক পেটালেন এমপির অনুসারীরা

দেশকে আরও এগিয়ে নিতে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

আন্তর্জা‌তিক প‌রিমণ্ডলে আলো ছড়া‌চ্ছে খুলনা বিশ্ব‌বিদ্যালয়

ডোনাল্ড লু’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিল বিএনপি : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

লুডু খেলতে নিষেধ করায় প্রাণ গেল কিশোরের

শেখ হাসিনাকে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন

সন্ধ্যানি লাইফ ইন্স্যুরেন্সে চাকরি, লাগবে না অভিজ্ঞতা

মহিলা দলের ৬ থানায় নতুন কমিটি ঘোষণা

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে সুসংবাদ দিলেন প্রতিমন্ত্রী

খেলোয়াড়দের ধর্ষণ-গর্ভপাতের অভিযোগ, সংগঠকের শাস্তি চায় মানবাধিকার কমিশন 

১০

বৈদেশিক ঋণের প্রকল্প দ্রুত শেষ করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

১১

ছাত্রদলের কর্মী সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা

১২

বারবার নীতি পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা : এফবিসিসিআই

১৩

কয়রায় সিপিজি সদস্যের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন

১৪

চায়না বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিকেএসপির সমঝোতা চুক্তি

১৫

ঢাকায় অতিরিক্ত গরমে আনসার সদস্যের মৃত্যু

১৬

হজযাত্রীবাহী বিমান উড়তেই ইঞ্জিনে আগুন, জরুরি অবতরণ

১৭

ঢাকায় নিয়োগ দেবে প্রাণ গ্রুপ, আবেদন করুন দ্রুত

১৮

তীব্র গরমে পথচারীর মৃত্যু

১৯

‘৩০ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দখলে শীতলক্ষ্যা নদীর দুই পাড়’

২০
X