আজ ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৭ ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রতি বছর ২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস (মাদকদ্রব্য অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস) পালন করা হবে। এবারের আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় পরিষ্কার যুক্তি, প্রতিরোধে মুক্তি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার জনিত হৃদয়কে নাড়িয়ে দেওয়া মর্মান্তিক কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাফিজুর রহমান নামের একজন ছাত্র কার্জন হল থেকে দৌড়ে এসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে এক ডাব বিক্রেতার ভ্যানে রাখা দা নিয়ে নিজের গলায় আঘাত করে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন, পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। হাফিজুরের মৃত্যুরহস্য উন্মোচিত হয়েছে। ভয়ংকর ড্রাগ সেবনে ও বিক্রিতে জড়িত বন্ধুরা তাকে এলএসডি সেবন করিয়েছেন। সেই সূত্রে ডিবি পুলিশ এলএসডি বাণিজ্য চক্রের সন্ধানে নেমেছে। সাফল্যও মিলছে। ধারণাতীত পরিমাণ এলএসডিও উদ্ধার হয়েছে। ধরা পড়েছেন আটজন। তারা বিভিন্ন পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের জড়িত থাকার ধরনধারণে জনপরিসরে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অভিভাবক মহলেও বিশ্ববিদ্যালয়গামী সন্তানদের বিষয়ে নতুন দুশ্চিন্তা বেড়েছে। কী ভয়ানক কথা ? এ ধরনের মাদক গ্রহণের ফলে আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগ্রত হয়।
কয়েক বছর আগে ঢাকার পুলিশ কর্মকর্তার কিশোরী মেয়ে ঐশী মাদকে আসক্ত হয়ে মা-বাবাকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যার দায়ে তাদের মেয়ে ঐশী রহমানকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। সন্তান মাদকে আসক্ত হওয়ার কারণেই সেদিন পুলিশ দম্পতিকে জীবন দিতে হয়েছিল নিজ সন্তানের হাতে। তবে ঘুরে ফিরেই আলোচনায় আসছে ঐশীর এই পরিণতি কেন হলো তা নিয়ে। ঐশী মাদকাসক্ত ছিল। ইয়াবার মতো ঘাতক নেশায় বুঁদ ছিল মেয়েটি। বাবা-মা তার এই উগ্রতায় বাধা দেওয়ায় সে চেয়েছিল স্বাধীন হতে। স্বাধীন হওয়ার চিন্তা থেকেই নিজের বাবা-মাকে ঘুমের বড়ি খাইয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে খুন করেছে বলে পুলিশের কাছে জবানবন্দিতে সে উল্লেখ করেছে। এখানে স্পষ্টতই মাদকের ভয়াবহতার নজির ফুটে উঠেছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ। এভাবে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ মাদকের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মাদকের থাবায় নাস্তানাবুদ একটি প্রজন্ম।
শহর থেকে গ্রাম, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-সর্বত্রই মাদক পাওয়া যাচ্ছে হাতের নাগালে।
বরগুনার আমতলীতে মাদকের টাকা না পেয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে স্ত্রী পলি বেগমের ডান হাত বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্বামী সাইদুর রহমান মৃধার বিরুদ্ধে। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, আমতলী উপজেলার দক্ষিণ টেপুড়া গ্রামের আবুল হাসেম মৃধার ছেলে সাইদুর রহমান মৃধা সরকারি হাসপাতালে অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরি করতেন। চাকরিরত অবস্থায় নেশায় জড়িয়ে পড়েন। ২০২০ সালে চাকরি থেকে তিনি অবসরে যান। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই মাদক সেবক করতেন। মাদক সেবনের টাকা না পেলেই স্ত্রী পলি বেগমের ওপর নির্যাতন চালাতেন।
কুষ্টিয়ায় মাদক কেনার টাকা দিতে অস্বীকার করায় ক্ষিপ্ত হয়ে স্ত্রী কে গলা কেটে হত্যা করেছে মাদকাসক্ত এক যুবক। এ সময় নিজ মাকেও তিনি কুপিয়ে গুরুতর জখম করেছেন বলে জানা গেছে। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ইবি থানার হরিনারায়ণপুরে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
কুমিল্লায় মাদকের বকেয়া ৫ হাজার বিনিময়ে স্ত্রী কে তিন ধর্ষকের হাতে তুলে দিয়েছেন এক স্বামী। কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার শাকপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী নারীর বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, ওই নারীর স্বামী একই গ্রামের নুরুল ইসলাম নুরু থেকে নিয়মিত মাদক নিতেন। সম্প্রতি সেখানে তার ৫ হাজার টাকা বাকি পড়ে যায়। সেই টাকার বিনিময়ে নিজ স্ত্রীকে কৌশলে ওই মাদককারবারীর হাতে কৌশলে তুলে দেন স্বামী। ওইদিন গভীর রাতে নুরু তার সহযোগী মনির ও মাহিনকে নিয়ে ওই গৃহবধূকে বিলে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন।
এ রকম অমানবিক ঘটনা অহরহ ঘটছে।
একসময় আমাদের সমাজে পারিবারিক বন্ধন, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সামাজিক অনুশাসন মানুষের জীবনযাপনকে পরিচালিত করত। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই অবস্থা অনেকটাই বদলে গেছে। আজকের তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ওয়েস্টার্ন মিউজিক, ড্রাগ কালচার, মাদককে জীবনযাপনের স্টাইল হিসেবে উপস্থাপন করা চলচ্চিত্র ও ওয়েব সিরিজগুলো মাদকের প্রতি কৌতূহল জাগিয়ে তুলছে।
মাদকাসক্তির পেছনে পারিবারিক বন্ধনের শিথিলতাও একটি বড় কারণ। যেখানে পরিবারে মমতা, যত্ন ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে, সেখানে সন্তানরা বিপথে যাওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। কিন্তু বর্তমানে অর্থকেন্দ্রিক জীবনের ব্যস্ততা, বাবা-মায়ের অতিরিক্ত কর্মব্যস্ততা কিংবা ভাঙনধর্মী পরিবারে বেড়ে ওঠা সন্তানরা সহজেই একাকীত্বের শিকার হয়। সেই শূন্যতা পূরণ করতে কখনো বন্ধুমহলের প্ররোচনা, কখনো মানসিক অবসাদ থেকেই তারা মাদকের দিকে হাত বাড়ায়।
যেসব পুরুষরা অ্যালকোহল কিংবা মাদকের উপর নির্ভরশীল থাকে, অন্যদের তুলনায় নারীদের উপর পারিবারিক নির্যাতন চালানোর আশঙ্কা তাদের ছয় থেকে সাত গুণ বেশি থাকে। নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য। গবেষকরা এক্ষেত্রে "সহোদরদের মধ্যে তুলনা" শুরু করেছেন এটা দেখতে যে, অ্যালকোহল এবং মাদক গ্রহণকারীদের পারিবারিক নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান আশঙ্কাকে অন্যভাবে যেমন পারিবারিক ইতিহাস ও জিনগত কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় কিনা। তারা দেখেছেন যে, যারা অ্যালকোহল বা মাদক নির্ভরশীল তাদের মধ্যে এই আশঙ্কা, তার অন্য ভাই-বোন যারা এটি গ্রহণ করেন না তাদের তুলনায় বেশি থাকে।"অ্যালকোহল এবং মাদকের ব্যবহার মানুষের প্রশমন করার ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়, যার কারণে এক পর্যায়ে সে কাছের সঙ্গীর সাথে সমস্যা সমাধানে সহিংসতাকে ব্যবহার করে," গবেষণায় বলা হয়। এতে, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং পারিবারিক কলহ ও নির্যাতনেরও সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। "যাদের মানসিক সমস্যা রয়েছে তারা তাদের মানসিক সমস্যার জটিল উপসর্গ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে অ্যালকোহল এবং মাদককে ব্যবহার করে," গবেষণায় বলা হয়।"এজন্যই অ্যালকোহল এবং মাদক জনিত সমস্যা অন্য মানসিক সমস্যা তৈরির ক্ষেত্রে প্রস্তুত করে যা পরবর্তীতে গিয়ে পারিবারিক নির্যাতনে রূপ নেয়।"
গুরুত্বপূর্ণ এই দিবসে আসুন আমরা সবার জীবন থেকে মাদকের কালো ছায়া দূর করতে এবং এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় মনোযোগ ও পদক্ষেপ নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই। এ বছরের মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস স্বাস্থ্য ও মানবিক সংকটে মাদকের চ্যালেঞ্জগুলোর প্রভাবের ওপর আলোকপাত করেছে।
সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দুর্যোগ, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যূতি ও দারিদ্র্যের কষাঘাত মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অন্তকলহ এবং কোভিড-১৯ এই খারাপ অবস্থাকে আরও খারাপ করে তুলছে। এদিকে, অপরাধীরা মানুষের দুর্দশার সুযোগ নিয়ে লাভবান হচ্ছে। কোকেন উৎপাদন এখন সর্বোচ্চ এবং গত এক দশকে মেথামফেটামিন জব্দের পরিমাণ পাঁচগুণ ও অ্যামফিটামিন জব্দের পরিমাণ চারগুণ বেড়েছে।
মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক এই দিবসে, এই অপতৎপরতা বন্ধে এবং ভূক্তভোগীদের সহযোগিতার বিষয়ে জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আবারও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছে। এসব প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে জনগণ, স্বাস্থ্য ও মানবাধিকারকে কেন্দ্র করে বৈষম্যহীন নীতিগত সমাধান, মাদক পাচার বন্ধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং মানুষের দুর্দশার সুযোগ নিয়ে যারা লাভবান হওয়ার চেষ্টা করে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা। আমাদের অবশ্যই মাদকসেবীদের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা ও সহযোগিতা সেবা জোরদার করতে হবে এবং তাদের ভুক্তভোগী হিসেবে চিকিৎসা দিতে হবে। মাদকসেবীদের সাজা ও বৈষম্য নয়, তাদের চিকিৎসা প্রয়োজন। মানবিক সংকটে থাকা লাখো-কোটি মানুষের জীবনে মাদককে আরও সমস্যা সৃষ্টি করতে দিতে পারি না আমরা।
গুরুত্বপূর্ণ এই দিবসে আসুন আমরা সবার জীবন থেকে মাদকের কালো ছায়া দূর করতে এবং এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় মনোযোগ ও পদক্ষেপ নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই। পরিশেষে পরিষ্কার যুক্তি, প্রতিরোধে মুক্তি এ প্রতিপাদ্য বিষয়টি যথার্থ এবং কার্যকর ভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে মাদকমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা যাবে বলে মনে করি।
লেখক: ড. মো. আনোয়ার হোসেন, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।
মন্তব্য করুন