

বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, ভূ-পৃষ্ঠের নিচের প্লেটগুলোর (টেকটোনিক প্লেট) নড়াচড়া ও সংঘর্ষের ফলে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। পৃথিবীর বাইরের শক্ত স্তর বা লিথোস্ফিয়ার কয়েকটি বিশাল খণ্ড বা প্লেটে বিভক্ত, এটি টেকটোনিক প্লেট নামে পরিচিত। পৃথিবীর ম্যান্টলের ওপর ধীরে ধীরে ভাসমান অবস্থায় থাকে এবং ক্রমাগত নড়াচড়া করে এই প্লেটগুলো। এই নড়াচড়ার হার সাধারণত বছরে কয়েক সেন্টিমিটার হতে পারে। প্লেটগুলো যখন ধাক্কা খেয়ে একে অপরের পাশ দিয়ে সরে যায়, তখন তাদের সংযোগস্থলে (ফল্টলাইন) প্রচণ্ড চাপ ও শক্তি জমা হতে থাকে।
যখন জমা হওয়া শক্তির পরিমাণ পাথরের সহ্যক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে, তখন হঠাৎ করে সেই শক্তি তীব্র কম্পন বা তরঙ্গের আকারে নির্গত হয়। এই কম্পন তরঙ্গগুলোই পৃথিবীপৃষ্ঠে কম্পন সৃষ্টি করে, যা আমরা ভূমিকম্প হিসেবে অনুভব করি। এছাড়া, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং মানুষের সৃষ্ট কিছু কার্যকলাপ (যেমন : বড় বাঁধ নির্মাণ, খনি অঞ্চলে বিস্ফোরণ) থেকেও ছোট আকারের ভূমিকম্প হতে পারে।
অন্যদিকে, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভূমিকম্পকে প্রায়শই ঐশ্বরিক নিদর্শন, সতর্কতা বা ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। যদিও এর ব্যাখ্যা ও জোর দেওয়ার ধরন ভিন্ন হতে পারে। ভূমিকম্প বিষয়ে বিভিন্ন ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি নিম্নে যোগ করা হলো : ইসলামে ভূমিকম্পকে মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সতর্কবার্তা বা পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কুরআন ও হাদিসে উল্লেখ আছে, এটি মানুষের পাপাচার ও অন্যায়ের ফল হতে পারে। ভূমিকম্পকে কেয়ামতের (শেষ দিনের) অন্যতম লক্ষণ হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে।
ইসলামের ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে, আল্লাহ অতীতে পাপী ও অবাধ্যতার জন্য একাধিক জাতিকে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে শাস্তি প্রদান করেছেন মর্মে উল্লেখ রয়েছে। পবিত্র কোরআনে নির্দিষ্টভাবে কয়েকটি জাতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তবে ঠিক কতগুলি জাতি ছিল তার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা বলা কঠিন। ভূমিকম্প দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জাতি হলো : হযরত সালেহের (আ.) জাতি (সামুদ)। সামুদ জাতি তাদের নবী সালেহকে (আ.) অস্বীকার করেছিল এবং আল্লাহর নিদর্শন উটনীকে হত্যা করেছিল। এর ফলস্বরূপ, তাদের ওপর এক প্রচণ্ড ভূমিকম্প (এবং/বা বিকট শব্দ) আঘাত হানে। এতে তারা তাদের ঘরে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকে।
হযরত শুয়াইবের (আ.) জাতি (মাদিয়ান)। মাদিয়ানবাসীরা ওজনে কম দিত এবং অন্যান্য পাপাচার করত। যখন তারা হযরত শুয়াইবের (আ.) সতর্কবাণী প্রত্যাখ্যান করে, তখন এক শক্তিশালী ভূমিকম্প তাদের গ্রাস করে এবং তারা তাদের বাড়িতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
হজরত লূতের (আ.) জাতি। এই জাতি সমকামিতার মতো চরম অশ্লীলতায় লিপ্ত ছিল। তাদের শহরগুলোকে (সাদোম ও গোমরা) উল্টে দেওয়া হয়েছিল, যার সাথে তীব্র ভূমিকম্প এবং আকাশ থেকে পাথরবৃষ্টি হয়েছিল।
হজরত মুসার (আ.) জাতির ৭০ জন লোক। বনী ইসরাইলের মধ্য থেকে নির্বাচিত ৭০ জন লোক আল্লাহর সাথে কথা বলার সময় তাদের পাপের কারণে ভূমিকম্পের শিকার হয়েছিলেন।
কারুন। কারুন, যে তার সম্পদ নিয়ে অহংকার করত, আল্লাহ তাকে তার সম্পদসহ জমিনে গেঁথে দিয়েছিলেন। যদিও এটি সরাসরি ‘জাতি’ নয়। তবে এটি পাপের কারণে মাটির গ্রাস করার একটি উদাহরণ।
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন- ‘১৫টি অপরাধের কারণে ভূমিকম্প আসবে। ১) যখন গনিমতের (যুদ্বলব্দ) মাল ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হবে, ২) যখন গনিমতের মাল লুটের মালে পরিণত হবে, ৩) জাকাতকে জরিমানা মনে করা হবে, ৪) ধর্ম বিবর্জিত শিক্ষার প্রচলন হবে, ৫) পুরুষ স্ত্রীর অনুগত হয়ে যাবে ৬) কিন্তু নিজ মায়ের অবাধ্য হবে, ৭) বন্ধু-বান্ধবকে কাছে টেনে নেবে, ৮) কিন্তু পিতাকে দূরে ঠেলে দেবে, ৯) মসজিদে কলরব ও হট্টগোল করবে, ১০) পাপাচারীরা গোত্রের নেতা হবে, ১১) নিকৃষ্ট লোক সমাজের কর্ণধার হবে, ১২) কোনো মানুষের অনিষ্ট হতে বাঁচার জন্য তাকে সম্মান দেখানো হবে, ১৩) গায়িকা-নর্তকী ও বাদ্যযন্ত্রের বিস্তার ঘটবে, ১৪) মদ পান করা হবে এবং ১৫) এই উম্মাতের শেষ যামানার লোকেরা তাদের পূর্ববতী মনীষীদের অভিসম্পাত করবে।’ ওপরের সবগুলোই আমাদের মাঝে বিরাজমান। তাই পাপ থেকে ফিরে আসা সময়ের দাবি।
এক হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, তখন তোমরা অগ্নিবায়ু, ভূমিধস, ভূমিকম্প, চেহারা বিকৃতি ও পাথর বর্ষণরূপ শাস্তির এবং আরো আলামতের অপেক্ষা করবে, যা একের পর এক নিপতিত হতে থাকবে, যেমন পুরানো পুঁতিরমালা ছিড়ে গেলে একের পর এক তার পুঁতি ঝরে পড়তে থাকে। (জামে আত-তিরমিজি, হাদিস নং ২২১১)
কোরআনে আর যিলযাল অর্থ- ভূমিকম্প নামের একটি স্বতন্ত্র সূরা হয়েছে। রাসুলের (সা.) সাহাবাদের বিশ্বাস ছিল মানুষের পাপ যখন বেড়ে যায় তখন ভূমিকম্প হয়।
আর বিশেষজ্ঞদের মতে ছোট ছোট ভূমিকম্পের পর বড় ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশে গত কয়েক দিনে দফায় দফায় ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়েছে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, যদি আল্লাহর আজাব আসে, আমরা ঈমান এনেছি ও নেক কাজ করি বলে আমাদেরও ছেড়ে দেবেন না। সময় আরও প্রমাণ করে - ইতিহাসে এমন অনেক জাতি ছিল যারা আমাদের মতো। যারা দুনিয়ার মোহে মত্ত ছিল, পাপাচারে মেতে ছিল, কিন্তু সময় তাদের গিলে ফেলেছে! কাজেই, আজাব আসার আগেই সতর্ক হওয়া জরুরি। ক্ষতি থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সবাইকে একে অপরকে উপদেশ দিতে হবে? পাপের দুনিয়া থেকে নিজে বাঁচার সাথে সাথে অন্যদেরও বাঁচানো জরুরি।
সকল গুরুতর পাপ এবং অন্যায়ের কারণে আল্লাহ পূর্ববর্তী বিভিন্ন সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছিলেন, তার অনেক কিছুই এই আধুনিক যুগেও সংঘটিত হচ্ছে। পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ধ্বংসের কারণগুলো প্রায়ই নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের সাথে জড়িত ছিল। এই একই ধরনের অপরাধ আজকের সমাজে ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান সময়ে সমাজে যে পাপ হচ্ছে, তা অতীতের সকল জাতির পাপের সমষ্টি। যে অপরাধগুলো পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ধ্বংসের কারণ হয়েছিল তা বর্তমানেও বিদ্যমান। এ অংশবিশেষ নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
পূর্ববর্তী অনেক সম্প্রদায় সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। বর্তমানেও বহু সমাজে স্রষ্টার অস্তিত্ব বা তাঁর নির্দেশের প্রতি অবিশ্বাস এবং বিভিন্ন ধরনের শিরক প্রচলিত আছে। আগের জাতিগুলো দুর্বলদের প্রতি জুলুম করত এবং সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করেনি। আজকের বিশ্বেও সমাজের ক্ষমতাবানদের দ্বারা দুর্বলদের ওপর অন্যায়, অবিচার এবং নিপীড়ন ব্যাপক মাত্রায় দেখা যায়। মাদইয়ান সম্প্রদায় ব্যবসায়িক লেনদেনে প্রতারণা করত এবং পরিমাপে কম দিত। এই যুগেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে জালিয়াতি, ধোঁকাবাজি ও আমানতের খেয়ানত প্রচলিত আছে। পূর্বের জাতিগুলো তাদের কাছে প্রেরিত নবী-রাসুলদের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেছিল এবং তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিল। যদিও এখন আর নবী আসবেন না, তবে আল্লাহর প্রেরিত নির্দেশনা উপেক্ষা করার প্রবণতা বর্তমান সমাজে লক্ষণীয়।
পূর্ববর্তী নবী ও রাসুলগণের উম্মতদের তাদের কৃত পাপাচারের জন্য আল্লাহতালা তাৎক্ষণিক শাস্তি প্রদান করতেন। এমনও দেখা যেত যে, পুরো কওমকে আল্লাহতালা তাৎক্ষণিক ধ্বংস করে দিয়েছেন। এ বিষয়ে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি আমার রবের কাছে তিনটি জিনিস চেয়েছিলাম, তার মধ্যে অন্যতম হলো - তিনি যেন আমার উম্মতকে সামষ্টিকভাবে ধ্বংস না করেন। আল্লাহ তা গ্রহণ করেছেন’ (সহিহ মুসলিম ২৮৭৯)। এটি সেই দোয়া যার কারণে আমাদেরকে আল্লাহ আদ, সামূদ, লূতের জাতির মতো একসঙ্গে ধ্বংস করেন না, যদিও আমরা গুনাহ করি।
বাইবেলে ভূমিকম্পকে ঈশ্বরের ক্ষমতা, বিচার বা উপস্থিতির প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে। এটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক ঘটনার সাথে সম্পর্কিত, যেমন যীশুর পুনরুত্থান বা শেষ দিনের লক্ষণ। এই গ্রন্থের দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো মানুষকে মনে করিয়ে দেয় যে, এই পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী এবং ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রাচীন বৈদিক ও হিন্দু সংস্কৃতিতে, ভূমিকম্পের পৌরাণিক ব্যাখ্যা রয়েছে। কিছু কিংবদন্তির মত অনুসারে, পৃথিবী মহাজাগতিক সর্প শেষ নাগের ফণার ওপর স্থাপিত এবং যখন তিনি অবস্থান পরিবর্তন করেন, তখন ভূমিকম্প হয়। ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যায় দেবতা বা দানবদের কার্যকলাপ বা মানুষের দুষ্কর্মের শাস্তি হিসেবেও ভূমিকম্পকে দেখা হয়।
বৌদ্ধধর্মে, ভূমিকম্পকে গভীর আধ্যাত্মিক কম্পনের প্রতীক মনে করা হয়। এটি বুদ্ধের জ্ঞানলাভ (মহাকাশস্প) বা তার মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত মহাজাগতিক অস্থিরতার প্রতীক হতে পারে। সূত্র শিক্ষাদানের সময়ও ভূমিকম্পকে শুভ লক্ষণ হিসেবে দেখা যায়, যা মহাজাগতিক প্রকৃতির পরিবর্তনশীলতাকে তুলে ধরে। অল্প কথায়, বেশিরভাগ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ভূমিকম্পকে একটি বৃহত্তর আধ্যাত্মিক বা নৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখে, যা মানুষকে তাদের বিশ্বাস, আচরণ এবং স্রষ্টার প্রতি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে চিন্তা করতে উৎসাহিত করে।
এই ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ কোনো জাতির প্রতি অবিচার করেন না, বরং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর জুলুম করে। এই শাস্তিগুলো ছিল অবাধ্য ও সীমালঙ্ঘনকারী জাতির জন্য সতর্কবার্তা।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভূমিকম্প সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে এর ক্ষয়ক্ষতি কমাতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, যেমন ভূমিকম্প-প্রতিরোধী নির্মাণ এবং ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা। সঠিক প্রস্তুতি- যেমন ভবনকে মজবুত করা এবং ভূমিকম্পের সময় সুরক্ষিত স্থানে আশ্রয় নেওয়া। তবেই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে এর জন্য করণীয় হলো আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাওবা করা এবং নিজেদের আচরণ সংশোধন করা। ভূমিকম্পকে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হয়। তাই এর ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে প্রধান কাজ হলো আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া, পাপ থেকে দূরে থাকা ও নিজের কার্যকলাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া।
ধর্ম ও বিজ্ঞান একমত যে ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। ভূমিকম্পের বিষয়ে বিজ্ঞান ও ইসলাম উভয় ব্যাখ্যাই মানুষের কাছে সৃষ্টিকর্তার অসীম ক্ষমতা ও মহত্ত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং নিজেদের শুধরে নেওয়ার আহ্বান জানায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক প্রেসিডেন্ট, ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল
মন্তব্য করুন