বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলো ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আযহা। ঈদ-উল-আযহা, যা আমরা সাধারণত কোরবানির ঈদ হিসেবে অভিহিত করি, এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো গরু, ছাগল, মহিষ, উট এবং দুম্বা পশু জবেহ। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কুরবানি হচ্ছে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কার লাভের আশায় নির্দিষ্ট পশু জবেহ করা।
ইসলামে হিজরি সনের ১২তম মাস জিলহজ্জ্ব মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত কুরবানি করার সময় নির্ধারিত। এ দিনগুলোতে বিশ্ব মুসলিম জাহান পশু জবেহের মাধ্যমে জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগ স্মরণ করেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর মাধ্যমেই কোরবানির প্রচলন শুরু হয়, যা এক অতি প্রাচীন ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত।
তবে এই নিবন্ধনের উদ্দেশ্য কোরবানির ইতিহাস নয়, বরং দরিদ্র বিমোচনে কোরবানির চামড়া কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়ে আলোকপাত করা।
কোরবানির চামড়া সম্পর্কে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “তোমরা কোরবানির পশুর চামড়া দ্বারা উপকৃত হও; তবে তা বিক্রি করো না।” এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, কুরবানিদাতা ব্যক্তি চামড়া বিক্রি করে তার মূল্য নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারবেন না। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে কোরবানির চামড়া দান করা উত্তম। সাধারণত যাকাত, ফিতরা পাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিরাই কোরবানির চামড়ার অর্থ পাওয়ার হকদার। তবে এক্ষেত্রে এতিম, হতদরিদ্র ও গরীব শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশে কুরবানিদাতারা সাধারণত চামড়া নিজেরা ব্যবহার করেন না। তারা চামড়া বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ গরীব-অসহায়দের মাঝে দান বা সদকা করে থাকেন। কোরবানির কিছুদিন আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি বর্গফুট হিসেবে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। এ বছর সরকার ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করেছে প্রতি বর্গফুট ৬০–৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫–৬০ টাকা। ঢাকার বাইরে এ মূল্য নির্ধারিত হয়েছে ৫৫–৬০ টাকা। খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২২–২৭ টাকা।
কিন্তু গত কয়েক বছরে অসাধু চামড়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে কুরবানিদাতারা চামড়ার যথাযথ দাম পাননি। ফলে বঞ্চিত হয়েছেন মূলত দেশের অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী। করোনা পরবর্তী সময় থেকে দেশে দরিদ্রতার হার বেড়েই চলেছে। গ্রাম অঞ্চলে সমাজভিত্তিক কুরবানি দেওয়া হয়, তবে চামড়ার মূল্য ব্যক্তি উদ্যোগে বিতরণ করা হয়।
আমরা যদি ব্যক্তি ভিত্তিতে নয়, বরং সমাজভিত্তিক বা মসজিদভিত্তিকভাবে কোরবানির চামড়ার মূল্য সংগঠিতভাবে ব্যবহার করি, তবে তা দরিদ্র বিমোচনে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। একত্রিতভাবে চামড়ার মূল্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা গেলে অসহায় ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী লাভবান হবে। পরীক্ষামূলকভাবে সমাজভিত্তিকভাবে চামড়া বিক্রির অর্থ একত্র করে দরিদ্রদের তালিকা তৈরি করে কর্মক্ষম ব্যক্তিদের স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
যেমন গ্রামীণ এলাকায় কাউকে একটি গাভি ক্রয় বা গরু মোটাতাজা করণের ব্যবস্থা করা, অটো রিক্সা বা অটো ভ্যান ক্রয় করে দেওয়া, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শ্রেণী তৈরী করা, মহিলাদেরকে সেলাই মেশিন ক্রয় করে দেওয়া, মৎস্য চাষের ব্যবস্থা করা, ছোট আকারে পোল্ট্রি করে দেওয়া, হস্তচালিত তাঁত শিল্পের ব্যবস্থা করা, জমি বর্গা নিয়ে ফসল উৎপাদন করা, ছোট আকারে মুদী মনোহারী দোকান করে দেওয়া, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপন করা, সবজি চাষের ব্যবস্থা করা, সামাজিক বনায়নের ব্যবস্থা করা, কর্মক্ষম শিক্ষিত দরিদ্র যুবকদের কে কম্পিউটারে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফ্রি ল্যান্সিং এর ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা যাতে পরিবেশের উন্নয়ন হয়, কন্যা দায়গ্রস্ত পিতামাতাকে কন্যার বিবাহের ব্যবস্থা করা, সৌখিন মৎস্য চাষের ব্যবস্থা করা, নার্সারির ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি।
কর্মক্ষম দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে যদি আমরা উপরোল্লেখিত বিভিন্ন উপায়ে স্থায়ী কর্মসংস্থান করা যায়, তাহলে ক্রমান্বয়ে দারিদ্র হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এ ছাড়াও সরকার তার প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা তথা জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে স্ব-স্ব জেলা ও উপজেলায় কোরবানির চামড়া বিক্রির টাকা দিয়ে নিজ নিজ অঞ্চলের প্রান্তিক অসহায় জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে কর্মক্ষম দরিদ্র জনগণকে স্থায়ী কর্মসংস্থান তৈরি করে দিতে পারে, যা দারিদ্র বিমোচনে গ্রামীণ অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। গ্রামীণ অঞ্চলে সমাজ ভিত্তিক বা মসজিদ ভিত্তিক কুরবানি করা হলেও শহরে জনগোষ্ঠী এক্ষেত্রে নিজ নিজ বাড়িতেই সাধারণত কুরবানি করে। সেক্ষেত্রে শহর অঞ্চলে সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর বা পৌর অঞ্চলে পৌর কাউন্সিলরের তত্ত্বাবধানে স্ব-স্ব অঞ্চলে কোরবানির চামড়া একত্রিত করে বিক্রি করে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে কর্মক্ষম অসহায় দরিদ্রদের কে স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়।
বছরে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ চামড়া আসে কুরবানি থেকে। গত বছরে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া মিলিয়ে কুরবানী হয়েছে ১ কোটি ০৪ লাখ পশু। কোরবানির পশুর চামড়া কেনা বেচায় প্রায় ১৫০০-২০০০ কোটি টাকার লেনদেন হয় বলে ধারণা করা হয়। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে চামড়া খাতে রপ্তানি আয় ছিল ৯৪ কোটি ১৭ লাখ ডলার, ২০২১ -২০২২ অর্থ বছরে চামড়া খাতে রপ্তানি আয় ছিল ১২৪ কোটি ৫২ লাখ ডলার, ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে চামড়া খাতে রপ্তানি আয় ছিল ১২২ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কম। চামড়া খাতের অব্যবস্থাপনা উদীয়মান চামড়া শিল্প খাতের বিপর্যয়ের প্রধান কারণ।
বিশেষ করে গত কয়েক বছর ঈদ উল-আযহায় সরকারি নির্ধারিত মূল্য তৃণমূল থেকে কাঁচা চামড়া না কেনায় অনেক কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়ে যায় এমনকি কাঁচা চামড়া বিক্রি না করে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। অথচ সরকার পরিকল্পিত ও সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চামড়া শিল্পে অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বৃদ্ধি এবং রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এজন্য কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে সরকারের যথাযথ নজরদারি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ট্যানারি মালিক সমিতির যৌথভাবে মনিটরিং করে কাঁচা চামড়ার ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
কোরবানির চামড়ার বাজার মূল্য ১৫০০-২০০০ কোটি টাকা সামষ্টিক ভাবে ব্যবহার করা গেলে তা দারিদ্র হ্রাসে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। প্রয়োজনে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার যাকাত বোর্ডের ন্যায় চামড়া বোর্ডের মত সংস্থা বা বোর্ড গড়ে তুলতে পারে। যে সংস্থা বা বোর্ডের কাজ হবে সম্বলিত ভাবে চামড়ার টাকা সংগ্রহ করে অসহায় হতদরিদ্রর মাঝে স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের আশু পদক্ষেপ কামনা করছি।
মুহাম্মাদ মাছুদুর রহমান: ব্যাংকার ও পিএইচডি গবেষক, ঢাবি
মন্তব্য করুন