আজ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। ১৯৯০ সালের ১১ জুলাই প্রথমবারের মতো ৯০টি দেশে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উদ্যাপিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ বছর বাংলাদেশও বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালন করতে যাচ্ছে।
এ বছর বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- ‘Empowering young people to create the families they want in a fair and hopeful world’ অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে বলে আমি মনে করি।
বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এই প্রতিপাদ্যটি মূলত জনসংখ্যা বিষয়ক সমস্যাগুলোর সমাধান এবং এসডিজি অর্জনের জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর আলোকপাত করে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী ও তরুণ। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, জীবনমান এবং ক্ষমতায়নের ওপর নির্ভর করে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন। একটি উন্নত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে এই কর্মক্ষম তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ, সুশিক্ষিত ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলা আবশ্যক।
বিশ্বের জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৮০০ কোটি। সহস্র বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১০০ কোটি। পৃথিবীর জনসংখ্যা ১৯৮৭ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৫০০ কোটিতে। তাহলে ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা কত হবে? এভাবে এত দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা ভাবায়, জনসংখ্যা বিষয়ক ধারণা ও গুরুত্ব জরুরি বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৮৭ সালে জনসংখ্যা ৫০০ কোটি হওয়ার প্রেক্ষাপটে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির পরিচালনা পরিষদ ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ প্রতিষ্ঠা করে। পরের বছর ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সারা বিশ্বে ১১ জুলাই এই দিবস উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বিশ্বে ১০০ কোটি মানুষ হতে শতসহস্র বছর লেগেছিল। পরবর্তী ২০০ বছর সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৭ গুণ। বিশ্ব জনসংখ্যা ১৯৮৭ সালে দাঁড়ায় ৫০০ কোটি, ১৯৯৭ সালে ৬০০ কোটি, ২০১১ সালে ৭০০ কোটি, ২০২১-এ ৭৯০ কোটি, ২০৩০-এ হবে ৮৫০ কোটি, ২০৫০ সালে বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৯৭০ কোটিতে, আর ২১০০ সালে হবে ১ হাজার ৯০ কোটি।
বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৯টি দেশে : ভারত, নাইজেরিয়া, কঙ্গো, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, তানজানিয়া, আমেরিকা, উগান্ডা, ইন্দোনেশিয়া। ২০২৮ সালেই ভারত হতে যাচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জনঅধ্যুষিত দেশ, যা চীনকেও ছাড়িয়ে যাবে। বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বর্ধনশীল দেশ হলো নাইজেরিয়া। অনেক দেশ আছে পৃথিবীতে যেখানে প্রতি মিনিটে ২৫০ শিশুর জন্ম হয়।
২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬৭ থেকে ৭১ বছর। এ গড় আয়ু ২০৪৫-৫০ সালে দাঁড়াবে ৭৭ বছরে। সম্ভাব্য গড় আয়ু ২০৯৫-২১০০ সালে হবে ৮৩ বছর। ষাটের দশক থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনমিতিক সূচকের ব্যাপক অগ্রগতি প্রশংসনীয় : জনসংখ্যা বৃদ্ধি ১.৩৭ শতাংশ, পরিবারপ্রতি গড় সন্তান ২.০৪, মাতৃমৃত্যু ১.৬৩ (প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে), নবজাতকের মৃত্যু ০-২৮ দিন ১৫ জন (প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে), ০-১ বছরের শিশুমৃত্যু ১১ জন (প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে), ০-৫ বছরের শিশুমৃত্যু ২৮ জন (প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে), পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার ৬৩.৯ শতাংশ, অপূর্ণ চাহিদা হ্রাস ১২ শতাংশ। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২.৮ বছর। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ৬৬ শতাংশ (১০ কোটি ৫৬ লাখ, ইউএনডিপি)।
বিশ্বজুড়ে জনবিস্ফোরণের বোঝা এই একটি পৃথিবীর পক্ষে বহন করা বা মানুষ-প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। এ কারণে গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলোর- কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, জলীয়বাষ্প, ওজোন, ক্লোরো-ফ্লুরো কার্বনের অতিরিক্ত ব্যবহারে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক উষ্ণতাজনিত দুর্যোগের অনিবার্য শিকার হয়ে তীব্র দাবদাহ, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, বজ্রপাত, ভূমিকম্প, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। এদেশের মানুষ, কৃষিজমি, সামগ্রিক উন্নয়ন ও অর্থনীতির ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে বাংলাদেশের। দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, অবকাঠামো, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বর্তমানে দেশে জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। দেশে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। ২০২৩ সালে ৬৯.৩ শতাংশ পুরুষ ও ৪৭.৪ শতাংশ নারী মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। ১৫ বছরের ওপরের ৮৬.৫ শতাংশ পুরুষ ও ৬২.৮ শতাংশ নারী মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। ২০২৩ সালে ১৫ বছরের ওপরের ৫৮ শতাংশ পুরুষ ও ৪২.৬ শতাংশ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করে। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে (পুরুষ ৮০.১ এবং নারী ৭৫.৮)। নারী-পুরুষ উভয়েরই গড় আয়ু বেড়েছে।
বাংলাদেশের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আগামী বছরগুলোতে দেশের প্রতিটি খাতের প্রতিটি নির্ঘণ্ট কী কী, ওই নির্ঘণ্টের বর্তমান অবস্থা কী, আগামীতে বাংলাদেশ উন্নয়নের কোন পর্য্যায়ে পৌঁছাতে চায়, তার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। যেমন শিক্ষার হার, নারী শিক্ষার হার, নারীর চাকরিতে অংশগ্রহণ বাড়ানো; দারিদ্র্য বিমোচন, ১ ডলারের নিচে আয়কারী মানুষের হার, শিশু ও মাতৃমৃত্যুহার কমানো; কিশোর-কিশোরীর শারীরিক মানসিক বিকাশে গুরুত্ব প্রদান, সর্বজনীন প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ, পরিকল্পিত পরিবার গঠন বিষয়ে সুস্পষ্ট গন্তব্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার পথে যেসব সমস্যা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার মধ্যে অন্যতম জনসংখ্যা সমস্যা। একটি দেশে জনসংখ্যা জনশক্তি হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্র গঠনের আবশ্যকীয় উপাদানও জনসংখ্যা। কিন্তু জনসংখ্যা যখন শক্তির বদলে সমস্যায় পরিণত হয় তখন দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের গতি হয়ে পড়ে মশ্বর।
পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র একটি দেশ কিন্তু জনসংখ্যার বিচারে পৃথিবীতে এর অবস্থান প্রথম দশে। ক্ষুদ্রায়তনের এ দেশটিতে অতিরিক্ত জনসংখ্যায় ভার যেন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে দেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে নানাবিধ বিপত্তির সৃষ্টি হয়েছে। জনসংখ্যার স্ফীতিরোধের কার্যকর উপায় দ্রুত উদ্ভাবন করা না গেলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। সাম্প্রতিককালে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে কিছু ইতিবাচক সূচক লক্ষণীয় হয়ে উঠলেও সামগ্রিক অবস্থার বিস্তারে তা মোটেই কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেনি। এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
বাংলাদেশে ১৮ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। নিরাপদ মাতৃত্ব, কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্য, নারীশিক্ষা ও নারী কর্মসংস্থানের জন্য নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে অধিক জনসংখ্যাবৃদ্ধির পেছনে কিছু কারণ শনাক্ত করা হয়েছে। তা হলো- ১. ভৌগোলিক পরিবেশ, ২. শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, ৩. ধর্মীয় গোড়ামি ও কুসংস্কার, ৪. দারিদ্র্যের আধিক্য, ৫. চিত্তবিনাদেন ও মননশীলতার সীমিত সুযাগে, ৬. বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ, ৭. জন্মহার ও মৃত্যুহারের ব্যবধান, ৮. ধর্মীয় ও সামাজিক প্রভাব, ৯. জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অজ্ঞতা, ১০. আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব।
অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘Optimum population is a boon, over population is a bane’ ‘সর্বোত্তম জনসংখ্যা আশীর্বাদ, অতিরিক্ত জনসংখ্যা অভিশাপ’। তাই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের একটি দেশকে আত্মনির্ভরশীল উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে হলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই করতে হবে।
সুস্থ-সবল জাতি গঠনের জন্য মা ও শিশুস্বাস্থ্য এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত কর্মসূচির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে নারী ও কন্যাশিশুর অপার সম্ভাবনাসমূহ কাজে লাগানো এখন সময়ের দাবি। জাতীয় উন্নয়নে নারীদের অধিকহারে সম্পৃক্ত করতে হবে। এছাড়া জেন্ডার সমতা অর্থাৎ নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি প্রচার-প্রসার ও সচেতনতার মাধ্যমে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। আমি ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস–২০২৫’ উপলক্ষে গৃহীত সব কর্মসূচির সার্বিক সাফল্য কামনা করছি।
বিশ্বের বিপুল জনসংখ্যা শুধু সংখ্যা নয়, কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন; সুযোগ ও নিত্যনতুন আবিষ্কারে তাদের মর্যাদাপূর্ণ তুষ্টিময় জীবন হয়ে উঠুক আগামী প্রজন্মের বাতিঘর। আমাদের বাংলাদেশও হয়ে উঠুক পরিকল্পিত জীবনযাপনের মাধ্যমে সুস্থ-সমৃদ্ধ জাতি। একটি সুস্থ-সবল জাতি গড়ার এই কর্মযজ্ঞে সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, বেসরকারি সংগঠন, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজকে আমি এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। আসুন, সবাই মিলে বাংলাদেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিই।
(লেখক : কলাম লেখক, কথা সাহিত্যিক, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল)
মন্তব্য করুন