রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, নিউটন, আইনস্টাইন কিংবা এডিসন—এরা কেউই ছিলেন না তাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। বরং অনেকে স্কুল শেষ করতে পারেননি, কারও নাম ছিল ‘অমনোযোগী ছাত্র’ তালিকায়, আবার কারও ক্ষেত্রে ‘অযোগ্য’ তকমা। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, তারা স্মরণীয় এবং বরণীয়। তারা প্রমাণ করেছেন, জীবনে সাফল্যের মানদণ্ড কোনো পরীক্ষার রেজাল্ট নয়।
কিন্তু খুবই দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে, আমাদের দেশের খবরের শিরোনামগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, ‘রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা।’ বিশেষ করে এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার সময় এসব শিরোনাম বেশি দেখা যায়। তাই সন্তানকে স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে অভিভাবকরা এক ধরনের অদৃশ্য আতঙ্কে থাকেন।
আত্মহত্যার কিছু কারণ ও সতর্ক লক্ষণ
একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত হঠাৎ নেয় না; এর পেছনে থাকে দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ, ব্যর্থতার লজ্জা, পরিবারের বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়া, একাকীত্ব এবং হতাশা বা ডিপ্রেশন। কিছু মানসিক রোগ আছে যেগুলো পরিবারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত যত্ন না পেলে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। যেমন ডিপ্রেশন, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসওর্ডার। যার জন্যে সাইকিয়াট্রিস্ট পরামর্শ প্রয়োজন।
আত্মহত্যার উপসর্গ
আত্মহত্যার কিছু সতর্কতা সংকেত রয়েছে। যেমন : আত্মহত্যার কথা বলা বা পরিকল্পনা করা, দীর্ঘসময় মনমরা হয়ে থাকা, একা থাকা, হঠাৎ আগ্রাসী আচরণ বা স্বাভাবিক আগ্রহ হারানো, রেগে গেলে বা কষ্ট পেলে কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ নিজের হাতে-পায়ে ধারালো বা সূঁচালো কিছু দিয়ে আঘাত করা, দেয়ালে মাথা ঠুকা। ‘আমার কিছু ভালো লাগছে না’অথবা ‘আমার দ্বারা কিছু হবে না’, এরকম কথা বার বার বলা।
বাংলাদেশের আত্মহত্যার চিত্র
বাংলাদেশে আত্মহত্যার পরিস্থিতি অতি উদ্বেগজনক। প্রতিবছর প্রায় ১০-১২ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। এর মধ্যে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ শতাধিক (Ain o Salish Kendra [ASK], 2023)। অর্থাৎ ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণরাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে (WHO South-East Asia, 2022)। গবেষণায়ও দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী কিশোর-তরুণদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ আত্মহত্যা।
এর দায় কার?
শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার দায় একার নয়—এ দায় আমাদের পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্র সবার। পরিবার যদি সন্তানকে শুধু নম্বর দিয়ে মাপতে চায়, স্কুল যদি কেবল পরীক্ষার ফলকে সাফল্যের মানদণ্ড বানায়, সমাজ যদি ব্যর্থতাকে কলঙ্ক মনে করে, রাষ্ট্র যদি উদাসীন থাকে, তাহলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ কখনো সম্ভব নয়।
প্রতিরোধ ও করণীয়
সাফল্যের পথ বহুমাত্রিক। জীবনে সফল হওয়া আর জীবন স্বার্থক হওয়া এক নয়। সৃজনশীলতা, শিল্প, খেলাধুলা, বিজ্ঞান, উদ্যোক্তা—যেকোনো দিকেই মানুষ যেমন সফল হতে পারে, তেমনি তার জীবনও স্বার্থক হতে পারে।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয় হলো, স্কুলে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা, নিয়মিত কাউন্সেলিং ও স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ক্লাস চালু করা। শিক্ষকরা যদি ভুলকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখান, শিক্ষার্থীরা ব্যর্থতায় ভেঙে পড়বে না। ‘কেন কম নম্বর?’ নয়, বরং ‘চেষ্টা করেছো, এবার আরও ভালো হবে’ এটাই বড় কথা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি), ইন্টারন্যাশনাল ফেলো আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন
মন্তব্য করুন