মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ড. নাজমুল আহসান
প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ০১:৩৭ পিএম
আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ০২:০৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

মানুষ হিসেবে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে মূল্যায়ন করার সময় এসেছে

ছবি : সৌজন্য
ছবি : সৌজন্য

বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠী একটি আলোচিত বিষয় কারণ বাংলাদেশে হিজড়ারা একটি আলাদা সমাজ তৈরি করে বহুকাল ধরে বসবাস করে আসছে। এই একই ধারায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে হিজড়া সমাজ গড়ে উঠেছে। আমাদের এই উপমহাদেশে যেভাবে হিজড়া সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, এমনটি আর কোথাও নেই। প্রকৃতপক্ষে হিজড়া জনগোষ্ঠীদের এক ধরনের জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী বলা যেতে পারে। পাশ্চাত্যে এই হিজড়া বা জন্মগত প্রতিবন্ধীরা পরিবারের সাথে বসবাস করে। এমনকি নিজেরাও নিজেদের সঙ্গী খুঁজে নিয়ে সংসারও করে থাকে। এতকিছুর পর প্রশ্ন হলো- এই হিজড়া কারা?

ইংরেজি প্রতিশব্দ হারমাফ্রোডাইট বা ইউনাক শব্দের অর্থধারীরাই এই হিজড়া হিসেবে পরিচিত। বাংলা ভাষায় হিজড়া শব্দটির অর্থ বোঝাতে গিয়ে অনেকগুলো প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যেমন- ক্লিব, নপুংসক, খোজা, বৃহন্নলা ইত্যাদি। ডাক্তারি ভাষায় হিজড়া তাদেরই বলা হয়ে থাকে, যাদের মধ্যে ক্রোমোজোমের ত্রুটি পাওয়া যায়।

আর যে কারণে ওই সব জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী মানুষদের, যাদের জন্মের পর ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়, তারাই প্রকৃতভাবে হিজড়া বলে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এদের ট্রান্সজেন্ডারও বলা হয়ে থাকে কারণ তারা জেন্ডারের যথাযথ নিয়ম অতিক্রান্ত মানুষ আর তাই এদের জন্মগত প্রতিবন্ধীতার নিরিখে লিঙ্গ নির্ধারণ করতে সমস্যা হওয়ার কারণে, তাদেরই অন্য ভাষায় ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে বিবেচিত করা হয়ে থাকে।

আমাদের সমাজে উনিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত হিজড়াদের নিয়ে অনেক কুসংস্কার ও কল্পকাহিনি প্রচলিত ছিল। বিজ্ঞানীরা উনিশ শতকের শেষের দিকে ক্রোমোজোম সম্পর্কিত গবেষণায় অবিশ্বাস্য সাফল্য অর্জন করেন। এই সাফল্যই নবজাতক শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণের পথকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার যে শব্দেই দেখি না কেনো, এদের মধ্যে দুই ধরনের হিজড়ারা বিরাজমান রয়েছে। এই হিজড়াদের মধ্যে একদল হচ্ছে প্রকৃত হিজড়া আর একদল হচ্ছে নকল হিজড়া। এই বিবেচনায় যারা প্রকৃত হিজড়া তাদের ডাক্তারি পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, তাদের শরীরের এক দিকে একটি শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয় এবং অপরদিকে একটি শুক্রাশয় অথবা ডিম্বাশয় থাকবে।

অনেকের পুরুষাঙ্গ না থেকে যোনি থাকে তবে তাদের নারীদের মতো স্বাভাবিক যোনি থাকে না। কখনো কখনো মূত্রনালি ও যোনিপথ এক সাথে থাকে। এমনকি কৈশোরে এদের মধ্যে স্তন গ্রন্থিরও প্রকাশ ঘটে এবং ঋতুচক্রও দেখা দেয়। এ ছাড়া সমাজে নকল বা ছদ্মবেশী হিজড়া রয়েছে যাদের চার ভাগে ভাগ করা যায়। ১. আকুয়া : যেসব পুরুষ নারী সাজতে ভালোবাসে এবং নিজেকে নারী মনে করে মানসিক তৃপ্তি পায়, তাদের আকুয়া হিজড়া বলে। এই হিজড়ারা সাধারণত লিঙ্গ রূপান্তরকামিতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এমনকি তারা নিজেদের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে চায়। ২. জেনানা : এরা হলো নারী সাজে সজ্জিত পুরুষ। তবে এরা আকুয়া নয় কারণ এরা নারী বেশে থাকতে মানসিক সুখ পায় না। হিজড়া সেজে কিছু সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকে। এরা স্বেচ্ছায় হিজড়া দলে আসে।

জেনানা হিজড়া আবার দুই ধরনের : ক) পৌরুষহীন জেনানা ও খ) যৌন ক্ষমতা সম্পন্ন জেনানা। ৩. ছিবড়ি : এদের যৌনাঙ্গের কোনো ত্রুটি নেই। স্বাভাবিক যে সব নারীরা হিজড়া সেজে থাকে, তাদের ছিবড়ি বলে। সাধারণত অসহায় ও উপায়হীন মহিলারা কখনো স্থায়ীভাবে বা কখনো অস্থায়ীভাবে এ পথ বেছে নেয়। ৪. ছিন্নি : এরা নিজেদের পুরুষাঙ্গচ্ছেদন করে ছিন্নি হিজড়া হয়ে থাকে। আকুয়া গ্রুপ থেকে অনেকে স্বেচ্ছায় ছিন্নিতে রূপান্তরিত হয়। সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞান সম্মতভাবে লিঙ্গ পরিবর্তন করা যথেষ্ট ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ। আর এ কারণে অবৈজ্ঞানিক উপায়ে অনেকে পুরুষাঙ্গচ্ছেদন করে এবং হরমোন থেরাপি নিয়ে অনেকে নারী বেশ ধারণ করার চেষ্টা করে থাকে।

তারা এই কাজটি এ কারণে করে থাকে, দেশের হিজড়া সমাজের কাছে হয়তো তারা কদর পাবে। আর এই মনে করেই তারা তাদের অনেকেই ভারতের কলকাতা থেকে এই কাজটি করে আসে। এই ধরনের কাজে বাংলাদেশে সামাজিক ও আইনি কোনো স্বীকৃতি নেই। বরং ফৌজাদারি দণ্ডবিধির ৩২৬ ধারা অনুসারে লিঙ্গচ্ছেদনকে একটি গর্হিত অপরাধ হিসেবে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে।

তথাপি হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে তর্ক বিতর্কের শেষ নেই। এরা বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় বহুদিন ধরে এদেশের নাগরিক হয়েও নাগরিক সুবিধা ও স্বীকৃতি যথাযথ ভাবে পায়নি। ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারের ক্যাবিনেট সভায় তাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং ২০১৪ সালে সমাজসেবা মন্ত্রণালয় থেকে তাদের হিজড়া বলে প্রথম স্বীকৃতি দান করে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই যে অন্যান্য উন্নত দেশে হিজড়াদের যেমন সামাজিক ও পারিবারিক সহানুভূতি রয়েছে, উল্টোভাবে আমাদের সমাজে হিজড়াদের প্রতি রয়েছে বৈষম্যমূলক আচরণ।

আর এ কারণেই তারা নিজেদের মধ্যে আলাদা বিচার ব্যবস্থা, এমনকি নিজের ভাষা তৈরি করে মূল স্রোত থেকে সরে গিয়ে এক আলাদা সমাজ গড়ে তুলেছে। হিজড়াদের এই সমাজে নেতৃত্ব দেয় তাদের গুরুমা। এই গুরুমায়েরা অধিকাংশই মূল স্রোতে ফিরতে চায় না। আর এই কারণে সচেতন সমাজও হিজড়াদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনটা অনুভব করে না। এসব কারণেই বাংলাদেশের হিজড়া সমাজ এক সুবিধা বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।

আসলে বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা ব্যক্তিরাই সঙ্গবদ্ধ হয়ে একটি আলাদা হিজড়া সমাজ গড়ে তুলেছে। এই অসাম্প্রাদায়িক হিজড়া সমাজে সবার সমান অধিকার রয়েছে। তবে এ কথা সত্যি, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী বা গুপ্ত লিঙ্গের ব্যক্তিকে চিকিৎসা এবং পারিবারিকভাবে পুনর্বাসন করে স্বাভাবিক জীবনে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। কিন্তু নিম্নবিত্তের প্রায় সকল জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধীরা হিজড়া দলে আসতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশের অনেক বাবা-মা তাদের গুপ্ত লিঙ্গের সন্তানকে হিজড়া ভেবে হিজড়া পল্লিতে দিয়ে আসেন। অত্যন্ত দুঃখের কথা এই যে বেশিরভাগ পরিবারে হিজড়া সন্তানরা সহানুভুতি পায় না। গুপ্ত লিঙ্গের কারণে এ ধরনের ব্যক্তিরা যৌন জীবন সমাজ ও পরিবারের দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক। আর এই কারণেই তারা পরিবারের ও সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এমনিভাবেই পরিবারের সাথে এদের দূরত্ব তৈরি হয়। এমনকি তারা হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ। এসব সামাজিক অসঙ্গতির কারনে অনেকে স্বেচ্ছায় হিজড়া দলে চলে আসে। সমাজ যে চোখেই দেখুক না কেনো, ধর্ম যেভাবেই উপলব্ধি করুক, মানুষ হিসেবে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র এ দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না!

ড. নাজমুল আহসান : নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাইসির হেলিকপ্টারের যে সমস্যার কথা জানালেন তুর্কি পরিবহনমন্ত্রী

সমর্থকের বাড়িতে নৈশভোজ, চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অর্থদণ্ড

ভোটের আগের রাতে গোপন প্রচারণা, দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর প্রাইভেটকার আটক

বিলাসবহুল গাড়িতে সরকারি লোগো সাঁটিয়ে ৭ লাখ ইয়াবা পাচার

ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা

বাবার খোঁজে ভারতে যাচ্ছেন এমপি আনারের মেয়ে

ফোর্বসের তালিকায় স্থান পাওয়া ৯ তরুণকে ছাত্রলীগের শুভেচ্ছা

মোবাইল কিনে না দেওয়ায় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাজার বসিয়ে অবৈধ বিদ্যুতের ব্যবসা

র‍্যাব হেফাজতে নারীর মৃত্যু, ক্যাম্প কমান্ডারসহ প্রত্যাহার ৪

১০

চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৫.৮২ শতাংশ : বিবিএস

১১

ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেল শিশুর

১২

জাল স্বাক্ষরে ওষুধ বিতরণের অভিযোগ

১৩

ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আরবদের মুনাফেকি ও সুপার হিরোদের অবদান

১৪

নোয়াখালীতে ৩০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ

১৫

নিপুনের পেছনে বড় কোনো শক্তি আছে : ডিপজল

১৬

ফিলিস্তিনের পক্ষে সংহতি জানিয়ে চবিতে সাইক্লিস্টের র‍্যালি

১৭

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আইআইইউসি প্রতিনিধিদলের সৌজন্য সাক্ষাৎ

১৮

আ.লীগ নেতার বিরুদ্ধে আপত্তিকর ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগ

১৯

রাইসির মরদেহ কোথায়, জানাজার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত?

২০
X