ড. ইশরাত জাহান
প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৪, ১১:০৯ পিএম
আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৪, ১১:১০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ই-সিগারেট

নতুন মোড়কে পুরনো সর্বনাশ

ড. ইশরাত জাহান। ছবি : সংগৃহীত
ড. ইশরাত জাহান। ছবি : সংগৃহীত

ই-সিগারেট। ধূমপানের আধুনিক ভার্সন। ধূমপায়ীরা একে বলে থাকে ভেপ (Vape)। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই ই-সিগারেট ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে এদেশের তরুণদের হাতেও। শুরুতে যখন ই-সিগারেট বাজারজাত হয়, তখন বলা হয়েছিলো যে ‘এটি ধূমপান ছাড়ার বিকল্প। সিগারেটের চেয়ে কম ক্ষতিকর। সেই সঙ্গে স্টাইলিশও।’ এসব বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই ফ্যাশন হিসেবে ই-সিগারেটের দিকে ঝুঁকে পড়েন। নিজেদের অজ্ঞাতসারে আসক্ত হয়ে পড়ে।

সিগারেট কোম্পানিগুলো এখন বিনিয়োগ করছে ই-সিগারেটে। টার্গেট তরুণ সমাজ। গত একদশকে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো ই-সিগারেটেও বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। তরুণদেরকে প্রলুব্ধ করার জন্যে নানানরকম প্রচারণা তারা চালাচ্ছে। বিশেষত ওটিটি ফ্লাটফর্মে নাটক সিনেমায় যে হরহামেশা ধূমপান ও ভেপিং করতে দেখা যায়। এটা মোটেও কাকতালীয় নয়, বরং সঙ্ঘবদ্ধ বিজ্ঞাপনী প্রচারণার অংশ। নায়ক-নায়িকা শিল্পী-মডেল মিউজিশিয়ানদের প্রকাশ্যে ভেপিং করার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দেয় এই তামাক কোম্পানিগুলো। যা দেখে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে তরুণরা। গোপনে ভেপিং মেলা আয়োজনের মাধ্যমেও তরুণদের আকৃষ্ট করার অপচেষ্টা তারা চালাচ্ছে। আসলে এটি তরুণ প্রজন্মকে নেশায় আসক্ত করার সর্বশেষ কৌশল।

ব্যাপারটা এমন নয় যে ভেপিং একেবারেই নতুন কিছু। ধূমপানের আদি ও বহুল ব্যবহৃত রূপটিকে আধুনিকতার মোড়কে নতুনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। নিকোটিনসহ ক্ষতিকর যে রাসায়নিক উপাদানগুলো বিড়ি-সিগারেটে পাওয়া যায়, প্রায়ই একই জিনিস আছে ই-সিগারেটেও। তবে সেবন রীতি এবং বাহ্যিক রূপটিতে কিছু নতুনত্ব আনা হয়েছে। বাঁকানো পাইপ, কলম, ফোন কিংবা পেনড্রাইভ- এমন অনেক বিচিত্র আকারের ই-সিগারেট পাওয়া যায়। মেশানো থাকে নানা সুগন্ধি ফ্লেভার। মোট কথা তরুণ সমাজকে আকৃষ্ট করার সব ব্যবস্থাই আছে এতে। নতুন মোড়কে এটি একটি পুরনো সর্বনাশ।

সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪৮ শতাংশ তরুণ, যাদের বয়স ২৪ বছর বা তার নিচে। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট’ সময়কাল অতিবাহিত করছে যেখানে, নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর তুলনায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি। আর বাংলাদেশে ই-সিগারেটের ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। আশ্চর্যে বিষয় হচ্ছে ই-সিগারেট যে সিগারেটের মতই ক্ষতিকর এটা অধিকাংশই জানে না। তারা ই-সিগারেটকে একটি ক্ষতিহীন ধূমপান ও স্মার্টনেসের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) তামাক নিয়ে তাদের প্রতিবেদনে ই-সিগারেটকে সুনিশ্চিতভাবে স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ইতোমধ্যেই ২০১৯ সালে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এছাড়া শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর ৩২টি দেশ এসব পণ্য নিষিদ্ধ করেছে। অস্ট্রেলিয়া ইতিমধ্যেই ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। কারণ দেশটিতে ই-সিগারেট এতটাই সহজলভ্য যে এটাকে মহামারি হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে ই-সিগারেট নিয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা উল্লেখ নেই। এমতবস্থায় এফসিটিসি’র আলোকে বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (সংশোধীত ২০১৩) সংশোধন করে ই-সিগারেট বা হিটেড টোব্যাকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।

২০৪০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনের লক্ষ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে এই বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে আরও শক্তিশালী ও বাস্তবমূখী করতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছয়টি সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সংশোধনী হলো-ই-সিগারেট ও হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট (এইচটিপি) নিষিদ্ধ করা। অন্যান্য প্রস্তাবগুলো হলো-তামাক কোম্পানির সকল সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বাতিল করা, বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ করা এবং সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির চিত্র ৫০ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ৯০ ভাগ করা।

আশা করা যায় প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো অতিদ্রুত পাস করে আইনে রূপদানের জন্য সরকার তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।

একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং ইতিবাচক পরিবর্তনে তরুণ জনগোষ্ঠীর অবদান অতি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ই-সিগারেট আমদানি, বিক্রয় ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করতে হবে। ই-সিগারেট বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হলে তরুণ ও কিশোর বয়সীদের ধূমপানে আসক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে, যা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে সহায়তা করবে।

লেখক: চেয়ারম্যান, ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথ, অতীশ দীপংকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফেসিয়ালের পর এইডসে আক্রান্ত ৩ নারী

প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেই ভুল থাকলে কী হয়

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল / বন্ধের পথে ‘কক্সবাজার স্পেশাল’ ট্রেন, যাত্রীদের ক্ষোভ

যেভাবে দেখবেন বাংলাদেশ-ভারত সিরিজ

খাগড়াছড়িতে বৃষ্টি চেয়ে ইসতিসকার নামাজ আদায়

৯৬ হাজার ৭৩৬ শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা

বিদ্যুৎস্পৃষ্টে একই পরিবারের ৩ জনের মৃত্যু

স্নাতক পাসে চাকরি দেবে সিটিজেনস ব্যাংক

এক কেজি ক্রিস্টাল মেথসহ আটক ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ডের ভোকাল

কৌশিক বসুর নিবন্ধ / যেভাবে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট্র

১০

জয়পুরহাটে বৃষ্টির কামনায় ইসতিসকার নামাজ

১১

এক মৌসুম পরেই আবারও প্রিমিয়ার লিগে লেস্টার সিটি

১২

চীনের মধ্যস্থতায় ঐক্য আলোচনায় বসছে ফিলিস্তিনি দুই গোষ্ঠী

১৩

লোহিত সাগরে ‘ব্রিটিশ’ জাহাজে ইয়েমেনিদের হামলা

১৪

পাবনায় বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ

১৫

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায়

১৬

হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিজস্ব সাদ্রি ভাষা

১৭

থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান

১৮

পটুয়াখালীতে ইসতিসকার নামাজ আদায়

১৯

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট / সিলেটে প্রস্তুত বাঘিনীরা

২০
*/ ?>
X