

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বেগম খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন।
খালেদা জিয়ার কারাজীবন
বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে মোট পাঁচবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন। এর মধ্যে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনবার, ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একবার এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একবার তাকে কারাগারে যেতে হয়।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে
১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার পর স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে খালেদা জিয়া তিন দফায় গ্রেপ্তার হন।
তিনি ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে এবং ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন। তবে এসব সময়ে তাকে দীর্ঘদিন কারাভোগ করতে হয়নি।
মঈনুদ্দিন–ফখরুদ্দিনের শাসনামলে
২০০৬ সালে তার সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচন রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংকটের কারণে স্থগিত হলে ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। ওই সময়ে দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়া ও তার দুই পুত্রের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মইনুল হক রোডের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে সিএমএম আদালতে হাজির করা হলে জামিন আবেদন নামঞ্জুর হয় এবং জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত বিশেষ সাব জেলে পাঠানো হয়।
কারাবন্দি অবস্থায় তিনি ২০০৭ সালের ১৪ অক্টোবর ঈদুল ফিতর এবং একই বছরের ২১ ডিসেম্বর ঈদুল আজহা জেলেই পালন করেন। ঈদের দিন পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ঈদের পোশাক, খাবার ও ফুল প্রদান করেন। এ সময় তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোও কারাগারে ছিলেন।
২০০৮ সালের ১৮ জানুয়ারি তার মা দিনাজপুরে মৃত্যুবরণ করলে, পরদিন ছয় ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়ে তিনি মায়ের মরদেহ দেখতে বাসায় যান। পরবর্তীতে দীর্ঘ ৩৭২ দিন কারাভোগের পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান।
শেখ হাসিনার শাসনামলে কারাজীবন
২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে মোট ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তাকে গ্রেপ্তার করে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। পরে গুরুতর অসুস্থতার কারণে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
প্রায় দুই বছরের বেশি সময় তিনি কার্যত কারাবন্দি অবস্থায় ছিলেন। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার শর্তসাপেক্ষে তার সাজা স্থগিত করে বাসায় থেকে চিকিৎসার অনুমতি দেয়। তবে এটি পূর্ণ মুক্তি নয়; আইনি শর্তে তিনি কার্যত গৃহবন্দি অবস্থায় ছিলেন।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাহী আদেশে তার দণ্ড মওকুফ করেন। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ২৭ নভেম্বর খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলা থেকে খালাস পান।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া
বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে টানা প্রায় ৪১ বছর দায়িত্ব পালন করছেন খালেদা জিয়া। ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগ দেন। পরের বছর মার্চে তিনি দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে পদোন্নতি পান। বিচারপতি আবদুস সাত্তার অসুস্থ হলে ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন এবং একই বছরের ১০ মে চেয়ারপারসন পদে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ১৯৯৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর দলের চতুর্থ কাউন্সিলে দ্বিতীয়বার, ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে তৃতীয়বার এবং ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের দশম কাউন্সিলে চতুর্থবারের মতো বিএনপির চেয়ারপারসন হন।
আন্দোলন-সংগ্রামে খালেদা জিয়া
বিএনপির দায়িত্ব নেওয়ার পরই নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়েন খালেদা জিয়া। দল ঐক্যবদ্ধ রেখে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে কোনোরকম সমঝোতা না করেই আপসহীন আন্দোলন করে গেছেন। ফলে এরশাদের পতন ত্বরান্বিত হয়।
১৯৮৩ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাতদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। একই বছর সেপ্টেম্বরে জোটের মাধ্যমে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফায় আন্দোলন চলতে থাকে। ওই বছরের ২১ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ সভাপতি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাতেও এরশাদবিরোধী আন্দোলনে দমে যাননি।
১৯৮৭ সাল থেকে খালেদা জিয়া ‘এরশাদ হটাও’ এক দফার আন্দোলন শুরু করেন। একটানা নিরলস ও আপসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি।
মন্তব্য করুন