শ্রীকৃষ্ণের শুভ আবির্ভাব তিথি জন্মাষ্টমী উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে মিছিল বা শোভাযাত্রা। জন্মাষ্টমী উপলক্ষে ঢাকা শহরে ঐতিহ্যবাহী ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এটিই জন্মাষ্টমীর মিছিল বা জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা নামে পরিচিত। ঢাকার এই ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রা তিনশ-চারশ বছরের বেশি পুরনো এবং এটি এক সময়ে ঢাকার অন্যতম প্রধান উৎসব ছিল, যা অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপিত হতো। বর্তমানে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির যৌথ উদ্যোগে রাজধানীতে পলাশীর মোড় থেকে জন্মাষ্টমীর কেন্দ্রীয় শোভাযাত্রা শুরু হয়ে গুলিস্তান হয়ে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে গিয়ে শেষ হয়।
ঢাকায় জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রাের ইতিহাস প্রসঙ্গে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব বলেন, বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ত্রিশ-চল্লিশের দশকে ঢাকায় জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রা গোটা উপমহাদেশের দৃষ্টি কেড়েছিল। এই শোভাযাত্রা দেখতে কলকাতা, আগরতলাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকে ঢাকায় আসতেন। জন্মাষ্টমীর দিন ঢাকায় (বর্তমানে পুরান ঢাকা) এক অসাধারণ পরিবেশ সৃষ্টি হতো। দুটি শোভাযাত্রা বের হতো- একটি ইসলামপুর থেকে, অন্যটি নবাবপুর থেকে। এক পর্যায়ে দুটি শোভাযাত্রাই একটিতে পরিণত হয়ে বর্ণাঢ্য রূপ নিয়ে কয়েকটি সড়ক পরিক্রমণ করত। এই শোভাযাত্রায় শোভা পেত শ্রীকৃষ্ণের নানা লীলাকাহিনীর বর্ণময় দৃশ্যপট। উল্লেখ্য যে, ইসলামপুর থেকে যে শোভাযাত্রাটি আসত, সেটি সংগঠিত করত নবাব পরিবার, অর্থায়নও তারাই করতেন। নবাব পরিবারের অনেক সদস্য শোভাযাত্রা সম্পৃক্তও হতেন। ১৯৪৭ সালের পর সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কারণে শোভাযাত্রাটি বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি বলেন, এই ঐতিহ্য প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। প্রায় চার দশক পর স্বাধীন বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি এই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনে। ১৯৯৩ সালে সংগঠন দুটি আবার জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা শুরু করে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে। শুরু হওয়ার পর কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটলেও তারা এই ঐতিহাসিক শোভাযাত্রা আরও বিস্তৃত করেছে; এখন সারাদেশে ঐক্যের চেতনা বহন করে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকায় কেন্দ্রীয় জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রায় উপস্থিতি প্রতি বছরই বাড়ছে। রাজধানীর প্রতিটি মন্দির ও সংগঠন শোভাযাত্রাে অংশগ্রহণ করছে নানা দৃশ্যপট নিয়ে, ধর্মীয় আঙ্গিক বজায় রেখে। এই ঐতিহাসিক জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রা সার্বজনীনতা ও সম-অধিকারের চেতনার বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, ঢাকার জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা পুরো বাংলায় বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। এই শোভাযাত্রা দেখতে গ্রাম-গ্রামান্তর এমনকি কলকাতা শহর থেকেও মানুষ ঢাকায় আসত। দর্শনার্থীরা যেসব নৌকায় ঢাকা আসতেন, সেগুলো সারাদিন বুড়িগঙ্গায় সারিবদ্ধভাবে নোঙর করা থাকত। কখনো বৃষ্টির কারণে যথাসময়ে শোভাযাত্রা শুরু করা না গেলেও তাতে দর্শকের উৎসাহের কোনো কমতি থাকতো না।
উইকিপিডিয়া আরও জানায়, কৃষ্ণদাস ঢাকার নবাবপুরে লক্ষ্মী-নারায়ণ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নবাবপুরের লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দির থেকে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা বের করা শুরু করেন। শোভাযাত্রায় একটি কাঠের মঞ্চে কৃষ্ণ, বলরাম, নন্দ, যশোদাসহ অনেকের বিগ্রহ থাকত। শোভাযাত্রায় বিভিন্ন মানুষ গোপ ও ব্রজবাসী সেজে ঘোড়ায় বা মাটিতে থেকে নাচগানে মুখর থাকতেন। বৈষ্ণব বসুকবৃদ্ধগণ পীতবসন পরে মাল্যপরিহিত হয়ে খোল-করতালের বাদ্যে হরিনাম কীর্তন করতেন।
কৃষ্ণদাসের মৃত্যুর পর চারপায়াবিশিষ্ট কাঠের চৌকিতে বিভিন্ন অবতারের মূর্তি প্রদর্শিত হয়। ধীরে ধীরে শোভাযাত্রার পতাকা, নিশান, বন্দুক-বর্শা, বল্লম-ছড়িধারী পদাতিক প্রভৃতি যুক্ত হয়। ক্রমেই বিভিন্ন সাজসজ্জায় শোভাযাত্রার গঠন ও কলেবর বৃদ্ধি পায়। কৃষ্ণদাসের প্রবর্তিত শোভাযাত্রাের উৎকর্ষে অন্যান্য ধনী ব্যবসায়ীরাও নিজেদের স্থাপিত মন্দির থেকে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা বের করা শুরু করেন।
মন্তব্য করুন