দেশে চলমান ভূমি বিরোধের ব্যাপকতার জন্য জমির রেকর্ড অব রাইটস বা খতিয়ানসংক্রান্ত জটিলতা অন্যতম প্রধান কারণ। ভূমি বিরোধের ইতিহাস অনেক পুরোনো হলেও আইনের শাসন বাস্তবায়নের মাধ্যমে একে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। আজ (১৯ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর সিরডাপের এ টি এম শামসুল হক মিলনায়তনে এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ভূমি বিরোধ পরিবীক্ষণ নাগরিক প্রতিবেদন ২০২৩’- শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ।
ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, কোনো প্রকল্প গ্রহণ করার আগে স্থানীয়দের বিশেষত ভূমি যারা ব্যবহার করছেন তাদের স্বাধীন মতামত নিতে হবে, সেক্ষেত্রে তাদের ভালোভাবে জানাতে হবে কী হতে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও এএলআরডি-র ভাইস চেয়ারপারসন ড. রওশন আরার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ মতবিনিময় সভায় প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন- বাংলাদেশ মহিলা পষিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম দিনাজপুরের সিডিএ-র নির্বাহী পরিচালক শাহ ই মবিন জিননাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, এএলআরডি-র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।
এর আগে ভূমিবিরোধ পরিবীক্ষণ নাগরিক প্রতিবেদন ২০২৩-এর খসড়া উপস্থাপন করেন এএলআরডি-র উপনির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান মনি এবং উপব্যবস্থাপক এ কে এম বুলবুল আহমেদ। প্রতিবেদনে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ২১ জেলা থেকে বড় আকারের ভূমি বিরোধের ৩৪টি কেস বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিরোধীয় ভূমির প্রকৃতি, ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী ও বিরোধীয় পক্ষের ধরন, ভূমি বিরোধের কারণ, বিরোধের প্রভাব এবং প্রতিকার প্রাপ্তি সম্পর্কে মূল্যায়ন ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে তারা দেখান, কেসগুলোতে বিরোধীয় জমির মোট পরিমাণ ১০,৮৫৩ হেক্টর এবং ক্ষতিগ্রস্ত মোট পরিবারের সংখ্যা ৫১, ২২৭টি, যেখানে কৃষক (২৪ টি কেসে) ও আদিবাসী (৯টি কেসে) বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এইসব বিরোধের কোনো কোনোটি ২ বছরের কম সময় ধরে চলমান (৫টি), কোনোটি ৫ বছরের কম সময় ধরে চলমান (৯টি) আবার কোনো কোনোটি ১৫ বছরের বেশি (৪টি) এমনকি ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান (৮টি)। এগুলোর মাত্র ৪টির নিষ্পত্তি গত বছর (২০২৩) এ হয়েছে, বাকি বিরোধগুলো চলমান রয়েছে। এসব বিরোধের বড় কারণ স্থানীয় প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থানে থাকা কৃষক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জমির মালিকানার দ্বন্দ্ব (২০টি কেসে), এরপর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রকল্প (৮টি কেসে)।
দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবের কারণে নারীর ভূমি কেন্দ্রিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ভূমির অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রেও বৈষম্য আছে। লিংগ, সমাজ, গোষ্ঠী/জাতিগোষ্ঠী, রাষ্ট্রীয় ভাবেও বৈষম্য হচ্ছে। ভূমিতে নারীর অধিকারে বৈষম্য আছে। আইনে নারীকে সম্পত্তিতে যতটুকু অধিকার দেওয়া আছে সেটারও বাস্তবায়ন নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, উন্নয়নকে আদিবাসী ও কৃষকরা ভয় পান কারণ তারা মনে করেন এর ফলে তাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ভূমিকে হারাতে হবে। কাজেই উন্নয়ন করতে গেলে তাদের কথা শুনতে হবে। উন্নয়ন চাপিয়ে দিলে হবে না, এটিকে জনগণকেন্দ্রিক করতে হবে, জনগণের মতামত নিয়ে করতে হবে।
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ভূমি ও কৃষি সংস্কারের গোড়ার কথা যারা ভূমিবঞ্চিত তাদের অধিকারের সুরক্ষা দিতে হবে। ভূমি বিরোধের কারণে তাদের বড় একটি অংশকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হতে হয়। প্রান্তিক মানুষের অধিকার নিয়ে যা করার কথা সেটি আমরা করছি কি না সেটিই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন হওয়া উচিত।
কমিউনিটি ডেভলপমেন্ট এসোসিয়েশন (সিডিএ) নির্বাহী পরিচালক শাহ ই মবিন জিন্নাহ বলেন, ভূমি বিরোধের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ জীবন ও জীবিকার ক্ষতি হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। এই মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলোর প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ফোকাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য আমাদের একটি অভিন্ন অবস্থানে আসা দরকার।
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন আদিবাসী নেতা অজয় এ মৃ, ফিলিমন বাস্কে, শেফালিকা ত্রিপুরা, মংচিন থান, নারায়ণ হাজং বিভিন্ন জেলা নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধি নাসিরুদ্দিন ময়নুল, রফিকুল আলম, আব্দুর রউফ, ভূমিহীন নেতা আলম বাচ্চু মেলকার, সখিনা খাতুন, সিরাজ খান, আব্দুল গাফফার প্রমুখ।
মন্তব্য করুন