ধারণা করা হয়, বন্যপ্রাণীদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র নিজেদের মধ্যে নাম ধরে যোগাযোগ করতে পারে। আর পৃথিবীর সর্ববৃহৎ স্থলচর স্তন্যপায়ী প্রাণী হাতি তাদের মধ্যে অন্যতম বলে দাবি করছেন গবেষকরা। নতুন এক গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, হাতিরা পরস্পরকে নাম ধরে ডাকে এবং প্রতিটি হাতির রয়েছে আলাদা আলাদা নাম।
গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভল্যুশন জার্নালে। আফ্রিকান সাভানা প্রজাতির হাতির ওপর পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, হাতির পাল যখন নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে শব্দ করে, তখন তার মধ্যে নামও থাকে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, যোগাযোগের সময় হাতির নিচু স্বরে কিন্তু উচ্চ তরঙ্গে করা ওই শব্দ অন্য হাতিরা অনেক দূর থেকেও শুনতে পায়। হাতি দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। তাই বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, কোনো হাতি যখন দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন খুব সম্ভবত নাম ধরে ডেকে তারা আবার একত্র হয়।
গবেষণায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগানো হয়। বিজ্ঞানীরা ৪ বছর সময় নিয়ে কেনিয়ার আফ্রিকান সাভানা হাতিগুলিকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে হাতিদের স্বর শোনেন। গবেষকরা এলিফ্যান্ট ভয়েস নামক মেশিন লার্নিং সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে হাতির দুটি পালের মধ্যে হওয়া কলগুলিকে বিশ্লেষণ করেন। এ সময় তারা হাতিদের কাছ থেকে প্রায় ৪৬৯টি অনন্য শব্দ শুনতে পান।
গবেষকরা দাবি করছেন, এই ভিন্ন ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র শব্দগুলি দিয়ে হাতিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করেছে এবং প্রতিটি হাতিকে আলাদা আলাদা শব্দে ডাকা হয়েছে। এ বিষয়ে ডিউক ইউনিভার্সিটির ইকোলজিস্ট স্টুয়ার্ট পিম বলেন, যদি আপনি একটি বড় পরিবারের খোঁজ করতে যান, আপনি হয়তো বলতে পারবেন, ‘ওহে, ভার্জিনিয়া, এখানে আসো!’
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বন্যপ্রাণীদের ক্ষেত্রে একে অন্যকে নাম ধরে ডাকার বিষয়টি খুবই বিরল। মানুষের নাম থাকে। এ ছাড়া পোষা কুকুর নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয়। ডলফিন শিশুদেরও নাম থাকে। নির্দিষ্ট শিস দিয়ে একে অন্যকে ডাকে। তোতা পাখিরাও সম্ভবত নাম ব্যবহার করে। যেসব প্রাণী নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয়, সেগুলোর সারা জীবনই নতুন নতুন শব্দ শেখার এবং সেগুলো উচ্চারণ করার ক্ষমতা রাখে। প্রাণীদের মধ্যে বিরল এই সক্ষমতা হাতিরও রয়েছে।
নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভল্যুশন জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণা প্রতিবেদনের গবেষকেরা কেনিয়ার সাম্বুরু ন্যাশনাল রিজার্ভ এবং আম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্কে থাকা সাভানা হাতির যে শব্দ লাইব্রেরিতে রেকর্ড করা আছে, সেগুলো যন্ত্রের মাধ্যমে সূক্ষ্মভাবে শুনেছেন এবং হাতিদের নামের ব্যবহার করার বিষয়টি শনাক্ত করেছেন।
হাতিদের মধ্য থেকে কে নাম ধরে ডাকছে আর কে সাড়া দিচ্ছে, সেটা বুঝতে গবেষকেরা জিপে করে হাতিদের অনুসরণ করেছেন এবং তাদের ভিডিও ধারণ করেছেন। যেমন মা হাতি তার বাচ্চা হাতিকে ডাকছে। অথবা পালের প্রধান হাতি দলের ছোট কোনো সদস্যকে ডাকছে।
গবেষকেরা যখন শুধু শব্দের উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন, কম্পিউটার মডেল ২৮ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো হাতিকে ডাকা হচ্ছে, সেটা শনাক্ত করতে পারছে। এ ক্ষেত্রে ডাকার সময় হাতি নাম ব্যবহার করছে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। গবেষকেরা তাদের গবেষণার ফল পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন হাতির আচার-আচরণ ভিডিও করেছেন। তারা সেই ভিডিওগুলো চালিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন, কোন হাতি কতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয়, কান নাড়ে এবং শুঁড় উঁচু করে।
গবেষক দলের একজন কর্নেল ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানী মিকি পারডো বলেন, ঠিক মানুষের মতো হাতিও নাম ব্যবহার করে। তবে খুব সম্ভবত বেশিরভাগ শব্দ করার সময় তারা নাম ব্যবহার করে না। তাই আমরা শতভাগ আশা করতে পারি না।
গবেষণা দলের আরেক সদস্য জর্জ উইটমেয়ার বলেন, হাতি অসাধারণ সামাজিক প্রাণী। তারা সব সময় পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে, স্পর্শ করে। এই নাম ধরে ডাকা খুব সম্ভবত তাদের পরস্পরের সঙ্গে আলাদাভাবে যোগাযোগ করার সক্ষমতার আরেকটি প্রমাণ।
মন্তব্য করুন