বসে আছি আদিল ঠোকারের বাড়িতে-পাহাড়ের ঢালুতে, এক শান্ত কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট ঘরটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। কাশ্মীরের পেহেলগাম হামলায় জড়িত থাকার সন্দেহে এই কাশ্মীরি যুবককে চিহ্নিত করেছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। আর সেই সন্দেহেই এক রাতের অন্ধকারে ভারতীয় সেনারা আইইডি বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে তার পৈতৃক বাড়ি।
এই বাড়িটির সামনে দিকে, এক প্রতিবেশীর ঘরে বসে স্তব্ধ চোখে চেয়ে আছেন আদিলের মা শাহজাদ। তার চারপাশে একঝাঁক রিপোর্টার, মাইক্রোফোন হাতে প্রস্তুত। প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন তারা। হঠাৎই একজন প্রশ্ন করলেন- ‘বাড়িটা যখন গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, আপনার কেমন লাগছিল?’
শব্দটা যেন হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়তেই থমকে গেলেন শাহজাদ। কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা, তারপর বললেন-‘ আমার সন্তান আদিল যদি সত্যিই ওই ঘটনায় জড়িত থাকে, তাহলে এই শাস্তি আমি মাথা পেতে নিচ্ছি।’
এরপর আর কিছু বলার সুযোগ পাননি তিনি। কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার মুখের ওপর, লাইভ শুরু হয়ে গেছে একাধিক চ্যানেলে। মুহূর্তেই তৈরি হয়ে গেল ‘মা’র মুখে ‘দ্রোহের স্বীকারোক্তি’ নামক একটি টেলিভিশনীয় নাটক।
একই দৃশ্য আরেক ‘আদিল’-এর বাড়িতে। পুরো নাম আদিল শাহ, বিপদে পড়া পর্যটকদের বাঁচাতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে তার। লিডার নদীর ধারে তাদের ক্ষুদ্র বাড়িটি আজ মিডিয়ার আখড়া। শামিয়ানার নিচে বসে থাকা তার পিতার চারপাশে ক্যামেরা-সেটিং-সাংবাদিকের ভিড়।
প্রশ্নের ধরন একই- আদিলের মৃত্যুর পর ঠিক কেমন লাগছে? উত্তরও যেন আগে থেকে মুখস্থ- দুঃখও আছে, আবার গর্বও হচ্ছে।
এই একটি বাক্য নিয়েই চলে সারাদিনের নাটক। বারবার ক্যামেরা চালু হয়, বারবার মুখে ঠোঁট ছোঁয়ানো হয় মাইক্রোফোন। আরেকটি লাইভ, আরও একবার আবেগের পুনরাবৃত্তি।
এটাই এখনকার কাশ্মীর রিপোর্টিংয়ের চিত্র। যুদ্ধের আবহ তৈরি করে চলেছে চ্যানেলগুলো। প্রতিদিন ‘কনভয়’-এর ভিডিও দেখিয়ে বলা হচ্ছে যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর পুরোনো ট্রাকে স্টিকার বসিয়ে বলছে, ‘নতুন যুদ্ধ ট্যাঙ্ক’। নদীর তীর থেকে চেনা পানি দেখে বলা হচ্ছে- এটাই সেই সিন্ধু, যা নিয়ে চলছে কূটনৈতিক সংঘাত!
এসব গল্পের বাইরেও আছে আরেক বাস্তবতা। যেমন উরিতে, সীমান্তের এক কিলোমিটার দূরে পৌঁছেছিল কয়েকটি সংবাদমাধ্যম। গুলি বিনিময় ঘটছিল, তবে সীমান্ত পার হয়নি। কিন্তু চ্যানেলগুলো সেই গুলিকেই বানিয়ে ফেলছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধের সংকেত।
কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ জানেন- সংঘাত কেমন হয়। তারা জানেন, বিপদ কখন ঘনিয়ে আসে। তারা আতঙ্কিত, কিন্তু টেলিভিশনের মতো করে নয়। তাদের ভয় ভবিষ্যতের জন্য।
টিভি চ্যানেলগুলো শুধু যে নাটক করছে তা নয়, নিরাপত্তাও হুমকিতে ফেলছে। ২৬/১১-র স্মৃতি এখনো টাটকা। সেসময় এনএসজি অভিযানের ছবি লাইভ দেখানো হয়েছিল, যা সন্ত্রাসীদের তথ্য পেতে সাহায্য করেছিল। ঠিক একই ভুল এবারও ঘটছে- পহেলগাম অভিযানের লাইভ সম্প্রচার।
সংবাদমাধ্যমের কাজ ঘটনা তুলে ধরা- তৈরি করা নয়। যখন তারা নাটক বানায়, তখন খবর আর খবর থাকে না, হয়ে ওঠে উত্তেজনার উপকরণ। ভারতীয় গণমাধ্যমের বড় একটি অংশ এখন সেই ভূমিকাতেই অবতীর্ণ- গল্প বলছে, জনতাকে খেপিয়ে তুলছে, বিভাজনের বার্তা ছড়াচ্ছে।
এই জনপ্রিয়তার খোঁজে ছুটে চলা যে কাণ্ড ঘটাচ্ছে, তা শুধু ভয়ের নয়- গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। এটা যেন এক অদ্ভুত ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ’ খেলা, যার মঞ্চে বসেছে টেলিভিশনের স্ক্রিনে, আর দর্শক হচ্ছে ১৪০ কোটি মানুষ।
ডয়চে ভেলে প্রকাশিত সাংবাদিক স্যমন্তক ঘোষের লেখা থেকে নেওয়া
মন্তব্য করুন