ভারতের ইতিহাসে অন্যতম দুঃসাহসিক প্রকৌশল প্রকল্প ‘চেনাব রেলওয়ে সেতু’র সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন এক নারী- অধ্যাপক জি মাধবীলতা। জম্মু ও কাশ্মীরের দুর্গম ও ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে গড়ে ওঠা এই সেতু শুধু রেল সংযোগ নয়, এটি এক নারীর অদম্য অধ্যবসায়ের সাক্ষ্যও।
২০০৩ সালে অনুমোদিত হয় বিশ্বের সর্বোচ্চ রেলওয়ে সেতু- চেনাব সেতুর নির্মাণ প্রকল্প। এটি ২৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুলা রেল সংযোগের অংশ। এই প্রকল্পে ১৭ বছর ধরে নিরলস কাজ করেছেন বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি)-এর জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক জি মাধবীলতা।
কে এই অধ্যাপক মাধবীলতা?
অধ্যাপক লতা ১৯৯২ সালে জওহরলাল নেহরু টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি (বিএসই) ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে এনআইটি ওয়ারাঙ্গল থেকে এমটেক এবং আইআইটি মাদ্রাজ থেকে পিএইচডি করেন ২০০০ সালে। ২০২১ সালে তিনি ‘সেরা নারী ভূ-প্রযুক্তি গবেষক’ হিসেবে ইন্ডিয়ান জিওটেকনিক্যাল সোসাইটির পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০২২ সালে ভারতের শীর্ষ ৭৫ নারী স্টিম ব্যক্তিত্বের তালিকায় তার নাম উঠে আসে।
চেনাব সেতুতে তার অনন্য অবদান
চেনাব সেতু নির্মাণ ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। কঠিন আবহাওয়া, খাড়া পর্বত এবং ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল- এই তিনে মিলেই নির্মাণ কার্য ছিল প্রায় অসম্ভবের মতো। সেই চ্যালেঞ্জকে জয় করেছেন অধ্যাপক মাধবীলতা ও তার দল।
তিনি ‘ডিজাইন-অ্যাজ-ইউ-গো’ পদ্ধতিতে কাজ করেছেন, যার অর্থ হলো সাইটে কাজ করার সময় ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে নকশা পরিবর্তন করা। কখনো ভাঙা শিলা, কখনো গোপন গুহা আবার কখনো অস্থিতিশীল মাটি- এসবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বদলাতে হয়েছে নির্মাণ কৌশল। শিলা স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করতে তার পরামর্শে ব্যবহার করা হয়েছে রক অ্যাঙ্কর, করা হয়েছে জটিল গাণিতিক বিশ্লেষণ।
সম্প্রতি তিনি ‘ইন্ডিয়ান জিওটেকনিক্যাল জার্নাল’-এর নারী বিশেষ সংখ্যায় তার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রকাশ করেছেন একটি গবেষণাপত্র- ডিজাইন ‘Design as You Go: The Case Study of Chenab Railway Bridge’।
কেন গুরুত্বপূর্ণ এই সেতু?
৩৫৯ মিটার উচ্চতার চেনাব সেতু আইফেল টাওয়ারের চেয়েও ৩৫ মিটার বেশি উঁচু। প্রকল্প ব্যয় হয়েছে প্রায় ১,৪৮৬ কোটি টাকা। এটি শুধু কাশ্মীর উপত্যকাকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করবে না, বরং অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে ভারতের জন্য এক বিশাল সংযোজন হবে।
তবে এই বিশাল কাঠামোর চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে একজন নারীর আত্মত্যাগ, নিষ্ঠা ও জ্ঞানের গল্প। প্রকৌশলের পুরুষতান্ত্রিক জগতে অধ্যাপক মাধবীলতা যেন এক প্রেরণার প্রতীক- যিনি সত্যি সত্যিই এক সেতুর সঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের ১৭টি বছর।
মন্তব্য করুন