মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি সব সংঘর্ষ বন্ধ করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। তবে ক্ষমতায় আসার প্রায় পাঁচ মাসের মধ্যেই এই আশাগুলো ভেঙে পড়েছে। ইসরায়েল ইরানে হামলা চালিয়েছে এবং গাজা ও ইউক্রেনে রক্তপাত অব্যাহত রয়েছে।
শুক্রবার ইসরায়েল বহু ইরানি লক্ষ্যবস্তুতে ব্যাপক ও বহুস্তর হামলা চালায়। বিশ্লেষকদের মতে, এই হামলা পুরো অঞ্চলজুড়ে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এই হামলা ট্রাম্পের জন্য একটি অপমানও বটে। কারণ তিনি বারবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে ইরানে হামলা না চালাতে অনুরোধ করেছিলেন। যদিও ট্রাম্প নিজেও বলেছিলেন, পারমাণবিক আলোচনা ব্যর্থ হলে তিনি ইরানকে বোমা মারবেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ব্রেট ব্রুয়েন বলেন, ‘এই হামলার প্রথম শিকার হচ্ছে ট্রাম্পের কূটনীতি। তিনি গাজায় যুদ্ধবিরতির কাছাকাছিও যেতে পারেননি। ইরানের সঙ্গে কিছু অগ্রগতি হচ্ছিল তবে নেতানিয়াহু তা নষ্ট করে দিলেন।’
হোয়াইট হাউস, ওয়াশিংটনে ইসরায়েলি দূতাবাস এবং জাতিসংঘে ইরানের মিশন, কেউই তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করেনি।
এ হামলা ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহকারী ও মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফের জন্যও একটি বড় ব্যর্থতা। উইটকফ ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সমাধানে কাজ করছিলেন, কিন্তু নেতানিয়াহুকে শান্ত রাখার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
অনেক ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ মহলও স্বীকার করছেন, হামলার আগেই ট্রাম্পের কূটনীতিক প্রয়াস ধাক্কা খাচ্ছিল। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হয়েছিল একটি বড় সাফল্য দিয়ে। গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি। কিন্তু সেই চুক্তি কয়েক সপ্তাহেই ভেঙে পড়ে।
তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু তাতেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। এমনকি ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য যে আব্রাহাম চুক্তি করা হয়েছিল, তা সম্প্রসারণের দিকেও কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বিদেশ নীতিতে বিভাজন
ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যেই বিদেশনীতি নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, পেন্টাগন ও পররাষ্ট্র দপ্তরের অনেক কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন বা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। উইটকফের কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকায় তাঁর ওপর আস্থা কমে যাচ্ছে।
গুরুত্বপূর্ণ ডেমোক্র্যাটরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু মিলেই এই সংকটের সৃষ্টি করেছেন। ওবামার সময়কার ইরান চুক্তি বাতিল করে ট্রাম্প কোনো কার্যকর বিকল্প উপস্থাপন করেননি।
ডেমোক্র্যাট সেনেটর ক্রিস মারফি বলেন, ‘এটা ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর তৈরি বিপর্যয়। এখন গোটা অঞ্চল ভয়াবহ যুদ্ধের পথে যাচ্ছে।’
পরিণতি অনিশ্চিত
এই হামলা বড় আঞ্চলিক যুদ্ধের জন্ম দেবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ইরান এই আঘাতের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক স্বার্থকে লক্ষ্যবস্তু করতে পারে। হুথি বিদ্রোহীরা আবার লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা শুরু করতে পারে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থামাতে ইসরায়েল কতটা সফল হবে, তাও প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে ইরানের ফরদো এনরিচমেন্ট প্ল্যান্ট গভীর ভূগর্ভে অবস্থিত– যেটি ধ্বংস করতে ইসরায়েল একা সক্ষম নয়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য দরকার, যা এখনও পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।
ইরান কীভাবে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেবে এবং ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী যেসব ইরানি নেতাকে তারা লক্ষ্যবস্তু করেছে, সেই হামলা কতটা কার্যকর হয়েছে, তা ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের সিরিয়া ইনিশিয়েটিভ প্রধান চার্লস লিস্টার বলেন, ‘যদি ইসরায়েল তাদের কথামতো সত্যিই একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযান শুরু করে থাকে, তবে ইরানের সরকার এক গভীর সংকটে পড়েছে। এতে সংঘাতের ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে।’
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশ্বের সংঘাত বন্ধ করে শান্তি আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ইরান হামলা তাঁর সেই প্রচেষ্টায় বড় ধাক্কা দিয়েছে। ট্রাম্প ও তার দূত স্টিভ উইটকফ কূটনৈতিক পথে এগোতে চাইলেও ইসরায়েলের নেতানিয়াহু তা অগ্রাহ্য করে হামলা চালান। এতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। গাজা, ইউক্রেন ও ইরান- কোনো ক্ষেত্রেই ট্রাম্পের কূটনীতিক উদ্যোগ সফল হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের ‘শান্তির দূত’ ভাবমূর্তি এখন বড় সংকটে পড়েছে।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স
মন্তব্য করুন