মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন মুখোমুখি যুদ্ধে ইসরায়েল ও ইরান। ইরানের রাজধানী তেহরানে শুক্রবার ভোররাতে ইসরায়েলের ব্যাপক আক্রমণের পর এই সংঘাত আর সীমিত পর্যায়ে নেই বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। সিএনএনের নিরাপত্তা বিশ্লেষক বেথ স্যানার বলেন, ‘ইসরায়েল এখন ইরানের সঙ্গে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।’
আর এ যুদ্ধের জবাবে ইরান যে হুমকি দিয়েছে, সেটি শুধু হুমকিতেই সীমাবদ্ধ নয়। এবার তা বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
ছয়শ’র বেশি মিসাইল হামলার সম্ভাবনা
ইসরায়েলের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান যে প্রতিশোধ নেবে, তার ইঙ্গিত বহু আগেই মিলেছিল। ইরান জানিয়েছিল, তারা একসাথে ছয়শ’রও বেশি হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক মিসাইল ছোঁড়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। এ তথ্য সামনে আসার পর থেকেই নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছিলেন, ইসরায়েল যদি উত্তেজনা বাড়ায়, তবে তার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে।
ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) এরই মধ্যে ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ থ্রি’ নামের একটি বৃহৎ সামরিক প্রতিশোধ অভিযানের ঘোষণা দিয়েছে। এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য হবে ইসরায়েলের বিমানঘাঁটি, রাডার ব্যবস্থা, এবং ভূগর্ভস্থ সামরিক ঘাঁটি ধ্বংস করা। বিভিন্ন সামরিক সূত্র বলছে, এই অপারেশন তিন ধাপে বাস্তবায়ন হতে পারে-
১. প্রথম ধাপে বিমানঘাঁটি ও রাডার ব্যবস্থার ধ্বংস, ২. দ্বিতীয় ধাপে হিজবুল্লাহ ও হুতি বিদ্রোহীদের মাধ্যমে সীমান্তে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, ৩. তৃতীয় ও চূড়ান্ত ধাপে ভূগর্ভস্থ ঘাঁটি থেকে হাইপারসনিক মিসাইল হামলা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরণের সমন্বিত আক্রমণ হলে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কতটা সক্ষমতা রয়েছে তা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষত, ইরানের বর্তমান সামরিক শক্তি আগের তুলনায় ১০ গুণ বেশি, যা এই যুদ্ধকে আরও ভয়াবহ করে তুলতে পারে।
ইসরায়েলের হামলা
শুক্রবারের ইসরায়েলি হামলা ছিল নিছক একটি সামরিক অভিযান নয়, বরং একটি বড় যুদ্ধের সূচনা। তেহরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানা এবং সামরিক কমান্ড ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দিয়েছে। এই হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ইরানের বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল হোসেইন সালামি এবং সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি।
এমন হত্যাকাণ্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যাবে না- এটি সুপরিকল্পিত, প্রতীকি এবং আক্রমণাত্মক। সিএনএনের বিশ্লেষক বেথ স্যানার বলেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরণের হামলা হতো এবং তাদের জেনারেল স্টাফ প্রধান নিহত হতেন, তবে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া কেমন হতো তা ভাবলেই বোঝা যায়, ইরানের ক্ষোভ কতটা যুক্তিসঙ্গত।’
অস্তিত্ব সংকটে ইরান
ইসরায়েলের হামলার পর ইরান এখন নিজেকে অস্তিত্বের সংকটে দেখতে শুরু করেছে। ফলে তাদের প্রতিশোধ হবে শুধু প্রতিক্রিয়ামূলক নয়, বরং অস্তিত্ব রক্ষার একটি বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ। আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘ইসরায়েলকে তিক্ত ও বেদনাদায়ক পরিণতি ভোগ করতে হবে।’
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান এবার আগের চেয়ে বড়, সুপরিকল্পিত ও বিধ্বংসী প্রতিক্রিয়া দেখাবে। ইতোমধ্যেই তারা ইসরায়েল লক্ষ্য করে ১০০টির মতো ড্রোন ছুড়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী। যদিও অনেক ড্রোন ভূপাতিত হয়েছে, তবে এটিই শেষ নয়।
আঞ্চলিক যুদ্ধের শঙ্কা ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
এই উত্তেজনা শুধু ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, ইরানের শক্তির মধ্যে রয়েছে হিজবুল্লাহ, হুতি, ও অন্যান্য মিলিশিয়া- এরাই এখন প্রস্তুত আছে যৌথ প্রতিক্রিয়ার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র, ইতোমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে জরুরি নয় এমন কর্মীদের সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আর তেল আবিবের এই সামরিক অভিযান পরিচালনায় ব্যবহৃত বেশিরভাগ বিমানই ছিল মার্কিন তৈরি।
অর্থাৎ, পরোক্ষভাবে হলেও যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। বিশ্লেষক রিচার্ড লে’বেরন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র না চাইলেও, এই সংঘাতে জড়াতে তাদের বাধ্য হতে হবে।’
মন্তব্য করুন