ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘটিত ১২ দিনের যুদ্ধ থেমেছে। মানুষ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছেন। রাজধানী তেহরানের রাস্তাগুলোতে এখন ফের ট্র্যাফিক জ্যাম, ক্যাফেগুলো খুলছে, বাজারে ক্রেতা ফিরছে—দেখতে যেন সব স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিকতার আড়ালে লুকিয়ে আছে যুদ্ধের ভয়াবহতা, আতঙ্ক আর ক্ষতবিক্ষত মানুষের আর্তনাদ।
মাত্র কদিন আগেই ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক অভিযানে তেহরানের বুকে আঘাত হেনেছিল মৃত্যুর বার্তা। ১২ দিনের সে যুদ্ধ এখনও মানুষের মনে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। কেউ বলছে, যুদ্ধ শেষ, কিন্তু ইরানিরা বিশ্বাস করতে পারছে না। কারণ তারা চোখে দেখেছে, প্রিয়জনের মৃত্যু, হাসপাতালের ওয়ার্ডজুড়ে রক্ত, আর ভবনের ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া চিৎকার।
কফি আর ক্ষত : বুফ ক্যাফের গাঢ় বাস্তবতা
তেহরানের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বুফ ক্যাফে—যেটি একসময় তরুণ-তরুণীদের মিলনকেন্দ্র ছিল, এখন সেখানে মাত্র দুটো টেবিলে বসে আছে কিছু মানুষ। একটিতে কালো ঘোমটায় ঢাকা এক নারী, অন্যটিতে জিন্স পরা এক তরুণী ও তার বন্ধু—যারা ইরানের কঠোর পোশাকবিধিকে উপেক্ষা করেছেন।
এই ক্যাফেটি একসময় মার্কিন দূতাবাসের নিকটবর্তী হওয়ায় জনপ্রিয় ছিল, এখনো এর আইসড আমেরিকানো কফি শহরের সেরা বলেই বিবেচিত। এখানেই কাজ করেন আমির, এক সাধারণ যুবক। তিনি বলেন, ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আমাদের ব্যবসায় খুব ক্ষতি করেছে। আমরা চাই, সম্পর্ক ভালো হোক। আমরা শুধু শান্তি চাই, যুদ্ধ নয়।’
ক্যাফের দেওয়ালে কাঠের বোর্ডে ঝুলছে একটি বার্তা—‘শান্ত থাকুন এবং কফি পান করুন।’
কিন্তু শান্ত থাকার সুযোগ কি আছে? একরাশ অনিশ্চয়তা আর আতঙ্ক এখন শহরের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে আছে।
হাসপাতালের ভেতরে যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ
তেহরানের তালেগানি জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে হেড নার্স আশরাফ বারঘি কাজ করছেন প্রায় ৩২ বছর। কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর জখম, এমন অসহায় মানুষের ভিড় আগে কখনো দেখেননি।
তিনি বলেন, ‘আমি ভয় পাচ্ছি। মনে হচ্ছে যুদ্ধ শেষ হয়নি। যে কোনো সময় আবার হামলা হতে পারে।’
গত ২৩ জুন এভিন জেলের কাছে ইসরায়েলের হামলায় আহত সেনা ও সাধারণ নাগরিকদের এখানে আনা হয়। সেই এভিন জেল, যা ইরানের রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য কুখ্যাত, তাকেই ‘প্রতীকী লক্ষ্যবস্তু’ হিসেবে বেছে নিয়েছিল ইসরায়েল।
একজন আহত কর্মচারী মোর্তেজা, যিনি জেলের ট্রান্সপোর্ট বিভাগে কাজ করতেন, বলেন—‘ইসরায়েল দাবি করে তারা শুধু সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করেছে। কিন্তু তা সত্য নয়। আমি তো সিভিল কর্মী, আমার হাত-পিঠ সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।’
সংকটের সময়েও গলা তুলে বলছেন ইরানিরা
শহরের অন্যতম প্রতীক আজাদি টাওয়ারের নিচে কান্নায় ভেঙে পড়েন তরুণী মিনা। তার চোখে কেবল হতাশা। তিনি বলেন, ‘আমরা শান্তি চেয়েছিলাম, উন্নত জীবন চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। যেন ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’
অন্যদিকে, এক উন্মুক্ত কনসার্টে তেহরান সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা দেশপ্রেমের গান বাজাচ্ছিল। জনতা একসাথে হলেও তাদের চোখে ছিল দুশ্চিন্তা।
তরুণ আলি রেজা বলছিলেন, ‘সরকারকে আমাদের কথা শুনতে হবে। আমরা কেবল স্বাধীনতা চাই।’
উপরে শান্ত, ভিতরে আগুন
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে বলেন, ‘আমেরিকা চায় আমরা আত্মসমর্পণ করি। তারা শুরু থেকেই ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বিরোধিতা করছে।’ এই বক্তব্য রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়, কিন্তু এর বাইরে চলছিল সাধারণ ইরানিদের এক অন্য লড়াই—বেঁচে থাকার।
এই যুদ্ধ কেবল একটি দেশের নয়, এটি তার মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। জীবন, স্বাধীনতা, আত্মসম্মান—সবই এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
এখন কী করবে বিশ্ব?
ওয়াশিংটন, তেহরান ও বিশ্বনেতাদের পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায় দিন গুনছে ইরানের মানুষ। কেউ বলছে, শান্তি ফিরবে। কেউ বলছে, এই যুদ্ধ ছিল শুরু মাত্র। আর সাধারণ মানুষ? তারা কেবল চায়, বেঁচে থাকতে, নিরাপদে, নিজের দেশের মাটিতে।
যুদ্ধ শেষ হলেও, তেহরানের প্রতিটি অলিগলিতে এখনো শোনা যায় ব্যথার প্রতিধ্বনি। শহর আবার জেগে উঠছে—কিন্তু এক অন্যরকম নীরবতায়। যে নীরবতা, শান্তির মতো হলেও, আসলে সে এক ভয়াবহ অসহায়তার নাম।
এরইমধ্যে নিয়ম-নিষেধের বেড়াজালে থেকেও ইরানিরা তাদের মনের কথা বলছে, অপেক্ষা করছে তাদের নেতা, ওয়াশিংটন ও বিশ্বনেতাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য—যা তাদের জীবনে বড় প্রভাব ফেলবে।
বিবিসি থেকে অনূদিত
মন্তব্য করুন