বিশ্বব্যাপী সামরিক প্রযুক্তির দৌড়ে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র এখন অন্যতম আলোচিত বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনসহ শীর্ষ সামরিক শক্তিগুলো যখন এই ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, তখন ইরানও পিছিয়ে নেই। দেশটি সম্প্রতি নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি “ফাতাহ” হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র উন্মোচন করে, যা তাদের সামরিক সক্ষমতাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র কী?
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র এমন এক ধরনের উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্র যা শব্দের গতির পাঁচ গুণেরও বেশি বেগে চলতে সক্ষম। অর্থাৎ এদের গতি হয় ম্যাক ৫-এর বেশি। ইরানের ফাতাহ ক্ষেপণাস্ত্রের গতি ম্যাক ১৩, যা ঘণ্টায় প্রায় ১৬,০০০ কিলোমিটার। এর ফলে ক্ষেপণাস্ত্রটি মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছাতে পারে।
ফাতাহ ক্ষেপণাস্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য
ইরানের তৈরি এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ১,৪০০ কিলোমিটার এবং গতি ম্যাক ১৩। এটি এর নিজস্ব আধুনিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে শত্রুপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।
গতিপথ পরিবর্তন ক্ষমতা : ফাতাহ ক্ষেপণাস্ত্র উড্ডয়নের সময় গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে, যা এটিকে আটকানো প্রায় অসম্ভব করে তোলে।
জ্বালানি : উন্নতমানের প্রপালশন সিস্টেম, যা দীর্ঘপাল্লা ও অতিদ্রুত গতি নিশ্চিত করে।
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য চ্যালেঞ্জ
বিশ্বের উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন প্যাট্রিয়ট, আয়রন ডোম বা থাড- এগুলোকে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে প্রচণ্ড সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ প্রচলিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র যেখানে পূর্বনির্ধারিত কক্ষপথে চলে, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র সেখানে যাত্রাপথে দিক পরিবর্তন করতে পারে। ফলে এর অবস্থান ও লক্ষ্য অনুমান করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ইরানের কৌশলগত বার্তা
ফাতাহ ক্ষেপণাস্ত্রের উন্মোচন কেবল প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, বরং এটি একটি কৌশলগত বার্তা বহন করে। ইরান দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির নিষেধাজ্ঞার মুখে থেকেও দেশীয় গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে এই অবস্থানে পৌঁছেছে। ফলে এ অস্ত্র এখন শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং বৈশ্বিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কাছেও আলোচনার বিষয়।
আঞ্চলিক ভারসাম্যে প্রভাব
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের এই অগ্রগতি মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। তারা মনে করেন, ইরানের প্রধান শত্রু ইসরায়েল, যার কাছে আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, ফাতাহ তাদের জন্যও নতুন হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। আবার উপসাগরীয় অঞ্চলে মোতায়েন মার্কিন ঘাঁটিগুলো এখন ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায়।
সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলো : যাদের সঙ্গে ইরানের ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন রয়েছে, তাদের নিরাপত্তা হিসাবেও নতুন ঝুঁকি তৈরি হলো।
সামরিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য
ইরানের জন্য ফাতাহ ক্ষেপণাস্ত্র শুধু প্রতিরক্ষার হাতিয়ার নয়, বরং রাজনৈতিক চাপ মোকাবিলারও একটি কৌশল। এটি একদিকে দেশের জনগণের কাছে প্রযুক্তিগত সক্ষমতার প্রমাণ, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক ধরনের শক্তির প্রদর্শন।
সার্বিকভাবে দেখা যায়, ফাতাহ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ইরানের সামরিক সক্ষমতার একটি যুগান্তকারী সংযোজন। এটি প্রতিপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো পর্যায়ে পৌঁছেছে। সাম্প্রতিক ইসরায়েল-ইরান ১২ দিনের যুদ্ধেও এই ক্ষেপণাস্ত্রের কার্যকারিতা প্রমাণিত। ফলে এটা নিশ্চিত যে, ইরান এই প্রযুক্তি অর্জনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক সমীকরণে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দিয়েছে।
সূত্র : পার্স টিভি
মন্তব্য করুন