অনেক দিন ধরেই ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে আরেকটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। তাদের এই আলোচনার মধ্যেই আগামীকাল সোমবারের মধ্যে চুক্তিটি সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে এখন বাইডেন বলছেন, সোমবারের মধ্যে এই চুক্তি হবে না। খবর সিএনএনের।
সংযমের মাস রমজানে গাজায় যুদ্ধবিরতি না হলে মানবিক সংকট আরও তীব্র হবে। এমনিতেই এরই মধ্যে বসতির জনপদে পরিণত হয়েছে উপত্যকাটি। এছাড়া ইসরায়েলের হামলার কারণে বেশ কয়েকজন জিম্মি নিহত হয়েছেন। ফলে ক্রমশ জটিল হচ্ছে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ পরিস্থিতি। এরইমধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এমন মন্তব্য করেছেন।
বাইডেনের এমন বক্তব্যের পর রমজানে গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত মঙ্গলবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসির এক অনুষ্ঠানে বাইডেন বলেন, ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনায় গতি এসেছে। সোমবারের মধ্যে দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতে পারে। গত সপ্তাহে এমন মন্তব্য করলেও এবার হতাশ করেছেন তিনি।
সোমবারের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হবে কি না, জানতে চাইলে বাইডেন বলেন, এখন তার কাছে এটি অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো ওই জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। আমি মনে করি, আমরা সেখানে পৌঁছাব কিন্তু এটি এখনো সেই পর্যায়ে যায়নি। এটি এখনই সেখানে না-ও যেতে পারে।’
চলতি বছর আগামী ১০ বা ১১ মার্চ রমজান মাস শুরু হবে। শেষ হবে আগামী ৯ বা ১০ এপ্রিল। এই এক মাস রোজা রাখবেন বিশ্বের সব মুসলিম। রমজানকে সামনে রেখে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বাইডেন জানিয়েছিলেন, ‘রমজান আসছে। এই রমজান মাসে গাজায় কোনো ধরনের সামরিক অভিযান না চালানোর বিষয়ে রাজি হয়েছে ইসরায়েলি পক্ষ। (হামাসের হাতে) বন্দি জিম্মিদের মুক্তি করাতে আমাদের সময় দিতেই রাজি হয়েছে ইসরায়েল।’
বর্তমানে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে নতুন চুক্তি সম্পাদনে আলোচনা চলছে। এতে মধ্যস্থতা করছে কাতার, মিশর ও যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে অধিকতর আলোচনার জন্য কাতার সফর করেছে ইসরায়েলি একটি প্রতিনিধিদল।
আলজাজিরা আরবি বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুপক্ষের মধ্যে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি হতে পারে। এ সময় হামাসের হাতে বন্দি ৪০ ইসরায়েলির মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলের কারাগারে আটক ৪০০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়া হবে।
এ ছাড়া যুদ্ধবিরতির সময়ে গাজায় ত্রাণবাহী ট্রাকের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হবে। সূত্রের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, গাজার হাসপাতাল ও বেকারি মেরামত করা হবে। প্রতিদিন ৫০০টির মতো ট্রাক ত্রাণসহায়তা নিয়ে গাজায় প্রবেশের অনুমতি পাবে।
যা বলছে মিশর
আসন্ন রমজানের আগেই গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শৌকরি। আনাতোলিয়া ডিপ্লোমেসি ফোরামের সম্মেলনে তুরস্কে এক ভাষণে তিনি বলেন, যুদ্ধের সব পক্ষ অর্থাৎ আমরা সবাই এরই মধ্যে সমঝোতার একটি পয়েন্টে পৌঁছাতে পেরেছি। আশা করছি রমজানের আগেই গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি হস্তান্তর শুরু হবে।
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত চুক্তি অনুযায়ী আগামী ১০ বা ১১ মার্চ যুদ্ধবিরতি শুরু হতে পারে। এ যুদ্ধবিরতিতে গাজায় ৪০ দিনের জন্য অভিযান বন্ধ রাখবে প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। এ সময়ে সেখানে প্রতিদিন অন্তত ৫০০ ত্রাণ ও খাদ্যপণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করবে। এর বিনিময়ে নিজেদের কবজায় থাকা জিম্মিদের মধ্যে থেকে ৪৫ জনকে মুক্তি দেবে উপত্যকার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাস।
মানবিক সংকট তীব্র গাজায়
গাজা যুদ্ধের মধ্যেই সম্প্রতি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন ওয়ারদাহ আহমেদ মাতার নামে ফিলিস্তিনের এক নারী। বর্তমানে তার মাথা গোজার ঠাঁই হয়েছে উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে। খাবারের তীব্র সংকটে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারছেন না এই মা। অন্য কোনো শিশুখাদ্য দিয়ে সন্তানের ক্ষুধা মেটানোরও কোনো সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে খেজুর ভিজিয়ে সেই পানি খাওয়াচ্ছেন নবজাতককে।
ওয়ারদাহ আহমেদ মাতার বলেন, খাওয়ার জন্য আমি শুধু ভাত আর ডাল পাচ্ছি। ফলে, বাচ্চা বুকের দুধ পাচ্ছে না। ওকে কিছু কিনে খাওয়াব সেই সামর্থ্যও নেই। তাই বাধ্য হয়ে খেজুর ভেজানো পানি খাওয়াচ্ছি। অথচ প্রথম সন্তান হওয়ার আগে এক দিন হাসপাতালে বিশ্রামে ছিলাম। কিন্তু এবার বাচ্চা হওয়ার মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে আমাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ, গোটা গাজায় মাত্র দু-একটি হাসপাতাল খোলা ছিল। ডেলিভারি রোগীর ভিড় ছিল অনেক বেশি।
অ্যাকশন এইড প্যালেস্টাইন এবং ইউরো-মেডিটেরেনিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটর বলছে, গাজায় ১০ হাজার সন্তানসম্ভাবা নারী রয়েছেন। যারা তীব্র ক্ষুধায় ভুগছেন। এর জেরে সন্তান জন্ম দেওয়ার পরেও বুকের দুধ খাওয়াতে পারছেন না এসব মায়েরা।
উপত্যকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে—যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজায় প্রায় ২০ হাজার শিশুর জন্ম হয়েছে। হাসপাতালগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ শিশুর জন্ম হয়েছে শরণার্থী শিবিরের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে। যাদের সিংহভাগই ভুগছে পুষ্টিহীনতাসহ নানা শারীরিক জটিলতায়। কিন্তু এর থেকে পরিত্রাণ চাচ্ছেন ওয়ারদার মতো ভুক্তভোগী ফিলিস্তিনিরা।
আহমেদ মাতার আরও বলেন, আমরা চাই যুদ্ধ বন্ধ হোক। আরব নেতাদের উদ্দেশে বলতে চাই—আমাদের সন্তানরা শেষ হয়ে যাচ্ছে, বিপদের এই দিনে দয়া করে আমাদের পাশে দাঁড়ান। আশা করছি—শিগগির এই যুদ্ধ শেষ হোক। আমরা ফিরে যাই আমাদের স্বাভাবিক জীবনে।
জাহাজে হামলা বন্ধে হুতিদের এক শর্ত
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল আগ্রাসন বন্ধ করলে লোহিত সাগর দিয়ে চলাচলকারী জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা বন্ধের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখার কথা জানিয়েছে ইয়েমেনের সশস্ত্র হুতি বিদ্রোহীরা। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলে তারা হামলা বন্ধ করবে কি না জানতে চাইলে হুতিদের মুখপাত্র মোহাম্মদ আবদুল সালাম রয়টার্সকে বলেন, গাজা অবরোধের অবসান এবং সেখানে মানবিক ত্রাণ সহায়তা অবাধে প্রবেশ করতে পারলে তারা পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করবেন। তিনি বলেন, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন ও অবরোধ বন্ধ হওয়া ছাড়া ফিলিস্তিনি জনগণকে সাহায্য করে এমন কোনো অভিযান বন্ধ হবে না।
মূলত গত অক্টোবরে গাজা যুদ্ধ শুরু হলে হামাসের প্রতি সমর্থন জানায় হুতি বিদ্রোহীরা। তাদের সমর্থনের অংশ হিসেবে নভেম্বর থেকে লোহিত সাগরে ইসরায়েলগামী ও ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জাহাজে হামলা করে আসছে তারা। এরপর এই তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের জাহাজের নাম যুক্ত করে ইরানপন্থি গোষ্ঠীটি।
মার্কিন সেনা সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ নভেম্বর থেকে লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরে ৩০টির বেশি জাহাজে হামলা চালিয়েছে হুতিরা। তাদের হামলার ভয়ে বেশিরভাগ জাহাজ কোম্পানি গুরুত্বপূর্ণ এই দুই নৌপথ এড়িয়ে গন্তব্যে পাড়ি দিচ্ছে। এতে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে পশ্চিমারা।
ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ৭ জিম্মি : হামাস
গাজা উপত্যকায় অব্যাহতভাবে হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েলের সেনারা। দেশটির সেনাদের হামলায় গাজায় আরও সাত জিম্মি নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামীদের সংগঠন হামাস। দলটি জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে তিনজন বিদেশি ও চারজন ইসরায়েলি রয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে শুক্রবার এক পোস্টে হামাসের সামরিক শাখা আল কাসেম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু উবাইদা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে কোন এলাকায় এ জিম্মিরা নিহত হয়েছেন তারা তিনি স্পষ্ট করে জানাননি।
টেলিগ্রামে এক পোস্টে তিনি বলেন, পাঁচ মাস ধরে চলা ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজায় বেশ কয়েকজন জিম্মি নিহত হয়েছেন। শুক্রবারে এ সংখ্যা দিয়ে নিহত ৭০ জন ছাড়িয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে প্রবেশ করে নজিরবিহীন হামলা চালিয়ে ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলিকে হত্যার পাশাপাশি প্রায় ২৫০ ইসরায়েলি ও বিদেশি নাগরিককে গাজায় বন্দি করে নিয়ে আসে হামাস। একই দিন হামাসকে নির্মূল এবং বন্দিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী এই সংগঠনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ইসরায়েল। গত নভেম্বরে সাত দিনের যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিনিময়ে ১১০ ইসরায়েলি বন্দিকে হামাস মুক্তি দিলেও এখনো তাদের হাতে ১৩০ জনের মতো বন্দি আছেন।
মন্তব্য করুন