ভারত-পাকিস্তানের টানা দুই সপ্তাহের সংঘর্ষে যখন দক্ষিণ এশিয়া রক্তাক্ত, আন্তর্জাতিক আকাশসীমা অনিশ্চয়তায়, অস্ত্রের বাজারে অস্বস্তি- তখন ‘নান অব আওয়ার বিজনেস’ বলে দূরে থাকা যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করেই মধ্যস্থতার ময়দানে হাজির।
প্রশ্ন ওঠে- কেন? যুদ্ধকে নিরপেক্ষ বলে উড়িয়ে দেওয়া মার্কিন প্রশাসন কেন মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দুই পরাশক্তিকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করিয়ে ফেলল? এই প্রশ্নের জবাব লুকিয়ে আছে বিশ্ব অস্ত্রবাজারের রূঢ় বাস্তবতায়, দক্ষিণ এশিয়ায় চলমান ক্ষমতার সমীকরণে এবং একটি ‘মার্কেট টেস্টিং’-এর কূটচালে।
ভারত-পাকিস্তানের এই সাম্প্রতিক যুদ্ধকে অনেকেই কেবল দ্বিপাক্ষিক বিবাদ হিসেবে দেখলেও বাস্তবতা ভিন্ন। এটি ছিল এক প্রকার ‘আর্মস শো’-যেখানে চীনা নির্মিত জে-১০ ফাইটার জেট, তুর্কি ড্রোন ও ইসরায়েলি প্রযুক্তির ক্ষমতা পরখ করার লড়াই চলেছে।
উল্লেখ্য, পাকিস্তান চীন-তুরস্ক নির্মিত অস্ত্র ব্যবহার করে অন্তত দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, যার মধ্যে একটি ছিল ফরাসি ‘রাফায়েল’। এতে পশ্চিমা অস্ত্র নির্মাতাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
এ বিষয়ে ভারত চুপ থেকেছে, তবে সিএনএন, রয়টার্স এবং ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ওয়্যার’-এর তথ্য অনুসারে, এই হারানো জেট বাস্তব এবং তা পশ্চিমা অস্ত্র নির্মাণ প্রযুক্তির প্রতি আস্থা কমিয়ে দেয়।
এই হামলা-পাল্টা হামলা পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে দক্ষিণ এশিয়ায় পশ্চিমা অস্ত্র বিক্রির বাজার হুমকির মুখে পড়ত। চীন ও তুরস্কের উত্থান এশিয়ার অস্ত্র বাজারে মার্কিন-ইউরোপীয় আধিপত্যের পরিণত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াত।
‘নান অব আওয়ার বিজনেস’ বলে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার যুক্তরাষ্ট্র জানত, যুদ্ধ বেশি দূর এগোলেই তারা থাকবে হেরে যাওয়া অবস্থানে। তাই তারা চুপচাপ যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করেছে- কার জেট কতদূর উড়ে, কার রাডার কত শক্তিশালী, কার ক্ষেপণাস্ত্রের ডিটেকশন সিস্টেম কত কার্যকর- সবই পরখ করেছে মার্কিন সেনা ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
তারপর যখন বোঝা গেল এই যুদ্ধ আরেকটু এগোলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অস্ত্র বাজারে চূড়ান্ত বিপর্যয় নামবে, তখনই কূটনৈতিক ফায়ার ফাইট শুরু করে তারা। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার আলোচনায় যুদ্ধবিরতি- এটাই প্রমাণ করে মধ্যস্থতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র চাইলে প্রথমেই এগোতে পারত।
তারা চেয়েছে একটি ‘অস্ত্রের শক্তি পরখের পর্ব’- যাতে ভবিষ্যতে অঞ্চলভিত্তিক চাপ প্রয়োগের গাণিতিক হিসাব নির্ধারণ করা যায়।
তীব্র এই সংঘর্ষে পাকিস্তানের পাশে শুরু থেকেই ছিল চীন ও তুরস্ক। অর্থনৈতিক ও কৌশলগতভাবে পাকিস্তানকে চীন দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে বহুদিন ধরেই। সিপিইসি করিডর, জে-১০ যুদ্ধবিমান, চীনা প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন- সব মিলিয়ে চীন কার্যত পাকিস্তানের অস্ত্র সরবরাহকারী প্রধান অংশীদার।
তুরস্কও পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথ ড্রোন উন্নয়নসহ সামরিক চুক্তিতে সম্পৃক্ত। এই নতুন জোট কার্যত ভারতের আধিপত্যবাদী কূটনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
অপরদিকে ভারত দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলের কাছ থেকে ড্রোন, এন্টি-ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল, স্পাই সফটওয়্যার কিনে আসছে। এই যুদ্ধেও ভারত ইসরায়েলের কাছ থেকে সহযোগিতা চেয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- ইসরায়েলের অস্ত্র ব্যবস্থাও যখন পাকিস্তানের চীন-তুরস্ক জোটের কাছে পরাজিত হয়, তখন আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাজারে ভারত নয়, বরং পাকিস্তান হয়ে ওঠে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
এদিকে ভারতীয় মিডিয়া ও সরকারের মধ্যে সাম্প্রতিক দমন-পীড়নের ঘটনা যেমন- ‘দ্য ওয়্যার’ ব্লক হয়ে যাওয়া- চাপা পড়া সামরিক ব্যর্থতা লুকানোর প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
যুদ্ধবিরতির আরেকটি বড় চাল ছিল পাকিস্তানকে আইএমএফ থেকে অর্থ ছাড় করিয়ে দেওয়া, ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও। এতে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনে আগ্রহী, বিশেষ করে যখন চীন তাদের উপমহাদেশে আরও সক্রিয়।
ভারত যখন একের পর এক কূটনৈতিকভাবে ব্যর্থ হচ্ছে- বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল এমনকি মালদ্বীপেও- তখন পাকিস্তান এই যুদ্ধের ভেতর দিয়ে প্রমাণ করেছে তারা একা নয়।
আন্তর্জাতিক ফ্রন্টে একের পর এক ব্যর্থতা, সামরিক দুর্বলতা প্রকাশ- সব মিলিয়ে মোদির শক্তিমান ইমেজ এখন সংকটে। উরি, পুলওয়ামার মতো নাটকীয় বিজয়ের পুনরাবৃত্তির চেষ্টা এবার হয়েছে উল্টো। বিলিয়ন ডলারের জেট হারিয়ে আন্তর্জাতিক দর কষাকষিতে অবস্থান হারিয়ে ভারত এখন আক্রমণকারী নয় বরং দুর্বল প্রতিরক্ষায় পরিণত হয়েছে।
‘নান অব আওয়ার বিজনেস’ বলে শুরু করা যুক্তরাষ্ট্রের হঠাৎ মধ্যস্থতা আসলে কূটনৈতিকভাবে গণিতনির্ভর সিদ্ধান্ত। এটি অস্ত্রের বাজার রক্ষায় নেওয়া দ্রুত পদক্ষেপ, ভবিষ্যতের সামরিক ভারসাম্য নির্ধারণে পূর্ব প্রস্তুতি। এই যুদ্ধ যে শুধু ভারত-পাকিস্তানের ছিল না, তা প্রমাণ হয়ে গেছে, এটা ছিল আন্তর্জাতিক অস্ত্র শিল্পের মাঠপর্যায়ের টেস্টিং ও কৌশলগত পুনর্বিন্যাস।
এখন প্রশ্ন, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিবিদরা কী বুঝবেন- সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে অন্যায্য কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায় না, আর মার্কিন ‘নান অব আওয়ার বিজনেস’ মানেই ‘শুরুতে দেখব, পরে নিয়ন্ত্রণে নেব’!
মন্তব্য করুন