ব্যাংকিং সেবাসহ নানা জটিলতার কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি দেশের মানুষের আগ্রহ অনেক কম। এ কারণে দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এখনো এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভিড়ছে না কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক তো দূরের কথা, বরং বহুল প্রচলিত মোবাইল ব্যাংকিং এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও সব ধরনের আর্থিক লেনদেন থেকে বিরত থাকছে মোট জনসংখ্যার ১০ বছরোর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর ৫২ দশমিক ৫৭ শতাংশ মানুষ।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর করা ‘আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ-২০২৩ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম আগ্রহ ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা নিয়ে। যার ফলে দেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে ১০ বছরোর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ মানুষের। তবে এদিক থেকে ২০ দশমিক ৮০ শতাংশ মানুষের সম্পৃক্তায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং। সব মিলে ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিংসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে এখন পর্যন্ত এই জনগোষ্ঠীর মাত্র ৪৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ মানুষ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় এসেছে।
এদিকে বর্তমানে দেশে ৬১টি ব্যাংক রয়েছে। ৬৪ জেলায় ব্যাংকগুলোর প্রায় ১১ হাজার শাখা রয়েছে। তবে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে আসতে পেরেছে মাত্র ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ মানুষ। এই বাস্তবতায় বিবিএসের এ জরিপ তথ্য আসলে দেশের এই বিপুলসংখ্যক ব্যাংকের কর্মকাণ্ডকেই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে, ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলা নিয়ে আগ্রহ কম থাকলেও আর্থিক লেনদেনে এগিয়ে রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং। জরিপ অনুযায়ী, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অ্যাকাউন্ট খুলেছে দেশের ২০ দশমিক ৮০ শতাংশ মানুষ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়সহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং সেবা। অর্থাৎ দেশের মানুষের আর্থিক লেনদেনে ব্যাংকের থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রতি আগ্রহ বেশি।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের মতে, দেশে মাত্র ৫ শতাংশ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট মোটেও সন্তোষজনক পরিসংখ্যান নয়। মূলত ব্যাংকিং সেবায় নানা জটিলতার কারণে ব্যাংক লেনদেনের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে, যার ফলে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলার হার কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে মোবাইল ব্যাংকিং সহজ এবং প্রান্তিক পর্যায়ে তাদের সেবা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে বলেই আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে সম্পৃক্ত মানুষের সিংহভাগই ঝুঁকছেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দিকে।
বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক এবং মোবাইল ব্যাংকের বাইরে মাইক্রো ক্রেডিট বা এনজিওতে অ্যাকাউন্ট রয়েছে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ মানুষের, নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানে ০ দশমিক ০৯, ইন্সুরেন্সে ০ দশমিক ১১, কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে ০ দশমিক ১০, ক্যাপিটাল মার্কেটে ০ দশমিক ০২, পোস্ট অফিসে ০ দশমিক ০২, সঞ্চয়পত্রে ০ দশমিক ০০৪ শতাংশ। এ ছাড়া একাধিক প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাউন্ট রয়েছে ১৮ দশমিক ০৯ শতাংশ মানুষের।
দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকার মূল কারণ হিসেবে দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব এবং সেবা সহজলভ্য না হওয়াকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, অনেক মানুষের ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই, তারা দিনে এনে দিনে খায়। এ ছাড়া ব্যাংক খাতে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার চরম অবনতি হয়েছে, যা আমানতকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি করছে। এসব কারণে তারা ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়েছে। তবে তাদের সচেতন করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলেন, ব্যাংকিং সেবা সহজলভ্য করতে হবে। আর্থিক সেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে তারা সরকারের অন্য সেবাগুলোও সহজে গ্রহণ করতে পারবে। এই সেবার ক্ষেত্রে সরকারকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যাংকিং সেবা যত বেশি বিস্তৃত হবে, সাধারণ মানুষ তত উপকৃত হবে এবং এটি অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ এখনো আর্থিক খাতের বাইরে রয়েছে। এটার কারণ তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছি না অথবা তাদের আর্থিক খাতের মধ্যে আনতে পারছি না। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিষয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতে যে একটা অস্থিরতা চলছে, যা আমানতকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি করছে। যে কারণে ব্যাংকের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে মানুষ। এসব কারণেই মূলত ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের অনীহা তৈরি হচ্ছে।