বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ ও ঝড়ের প্রভাবে কয়েকদিন ধরে সারা দেশেই কমবেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে রাজধানীসহ দেশের সব বাজারে। ঢাকার অধিকাংশ বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কম থাকলেও সবজি, চাল, মুরগি, ডিম, মাছসহ নিত্যপণ্যের দাম বেশি। বন্যা ও বৃষ্টির কারণে বাজারে সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
গতকাল রোববার রাজধানীর শ্যামবাজার, রায়সাহেব বাজার, নয়াবাজার, কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল ও নিউমার্কেট কাঁচাবাজারসহ অনেক বাজারে দেখা যায় এ চিত্র। রায়সাহেব বাজারের ডিম ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী বলেন, বৃষ্টি ও বন্যার কারণে পাইকারি বাজারে ডিম পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে দাম বেড়েছে।
এদিন রাজধানীর খুচরা বাজারে ডজনপ্রতি ৫ টাকা বেড়ে ফার্মের সাদা ডিম ১৫৫ টাকা এবং লাল ডিম বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকায়। হাঁসের ডিম ডজনপ্রতি ৩০ টাকা বেড়ে ২১০ টাকা এবং দেশি মুরগির ডিমের হালি বিক্রি হয় ৮০ টাকায়। মুরগির বাজার ঘুরে দেখা যায়, কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির দাম। বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। এ ছাড়া সোনালি মুরগি ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা এবং দেশি মুরগি ৫২০ থেকে ৫৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
শ্যামবাজারের মুরগি ব্যবসায়ী আলী হোসেন জানান, বৃষ্টির কারণে পরিবহনকারী গাড়ি আসতে পারছে না। সম্প্রতি বন্যা ও বৃষ্টিতে অনেক খামার ডুবে গেছে। এতে বাজারে মুরগির সংকট দেখা দিয়েছে। তাই দামও কিছুটা বাড়তির দিকে। গরুর মাংস কেজিপ্রতি ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকা এবং খাসির মাংস কেজিপ্রতি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, কেজিতে ৪০ টাকা বেড়ে কাঁচামরিচ ২০০ টাকা এবং টমেটো ২০ টাকা বেড়ে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া করলা ৬০ টাকা, শিম ১৬০ টাকা, বেগুন মানভেদে ৭০ থেকে ৮০ টাকা, দেশি গাজর ১০০ টাকা, চায়না গাজর ১৫০ টাকা, পেঁপে ৩০ টাকা, কাঁকরোল ও বরবটি ৬০ টাকা এবং ঢ্যাঁড়শ, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, কচুরমুখি, শসা, পটোল, মুলা ও ধুন্দল বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকায়।
এ ছাড়া লেবুর হালি ১০ থেকে ২০ টাকা, ধনেপাতার কেজি ১০০ টাকা, কলার হালি ৪০ টাকা এবং মিষ্টি কুমড়া কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। ১০ টাকা বেড়ে আলু হয়েছে ৭০ টাকা কেজি। ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকায় দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়ে হয় ১২০-১৪০ টাকা। সম্প্রতি মিশরীয়, পাকিস্তানি ও চীনা পেঁয়াজের আমদানি বাড়ায় দাম কমে দেশি পেঁয়াজ ১০০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রায়সাহেব বাজারের খুচরা পেঁয়াজ বিক্রেতা আলমগীর বলেন, দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়তি বলে বিদেশি পেঁয়াজের চাহিদা বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। তবে এদিন পাইকারি বাজারে ৬-৭ টাকা কমেছে। ফরিদপুরে কেজি ১০৩-১০৪ টাকা ও পাবনায় বিক্রি হচ্ছে ১০৫-১০৬ টাকায়। দুদিন আগেও যা ছিল ১১০ টাকা।
বাজারে পাঁচ কেজি সয়াবিন তেল ৮১৮ টাকা, দেশি মসুর ডালের কেজি ১৩০ টাকা, রসুন ২২০ টাকা এবং আদা ২২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। চালের বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে।
এদিন রাজধানীর বাজারে মোটা চাল ৫৫ টাকা, মিনিকেট ৭০ টাকা, আটাশ চাল ৫৮ টাকা, লাল আমন ধানের চাল ৭৫ টাকা ও সুগন্ধী চিনিগুঁড়া পোলাওয়ের চাল ১২৫ টাকায় বিক্রি হয়। বাবুবাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মোহম্মদ শাহীন মিয়া জানান, ঋণ না পাওয়ায় ছোট আকারের প্রায় পাঁচ হাজার চালের মিল বন্ধ। বাজারে পুরোনো চালের দাম সবসময়ই একটু বেশি। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধান এলে দাম কমবে। তার অভিযোগ, বসুন্ধরা, প্রাণ, সিটি গ্রুপ, স্কয়ার ও এসিআই গ্রুপের মতো বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সারা বছর চালের জোগান দেওয়ার জন্য ধান গুদামজাত করে। সরকার তাদের বিনা দ্বিধায় ঋণ দেয়। আর তারা ধান কিনে মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এবং ইচ্ছামতো চালের দাম বাড়ায়। চালের বাজারের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে শক্ত হাতে এসব করপোরেটের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। এ ছাড়া কীটনাশক, সেচ ও শ্রমিক মজুরি বাড়ায় মিল মালিকদের বেশি দামে ধান কিনতে হয়।
বাবুবাজার এলাকার আরেক আড়ত মালিক মো. নিজাম মোল্যা বলেন, উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন মিল ও চাতালের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিনের নির্ধারিত বাজারমূল্যে চাল কেনেন ব্যবসায়ীরা। এসব চাল আড়তে এনে বাজারমূল্য অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে বিক্রি করা হয় ক্ষুদ্র পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। এ পদ্ধতিতে চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে চালের দাম।
তিনি আরও বলেন, এ সময়ে চালের দাম কমার কথা। অথচ মিলগেটে প্রতিদিনই বাড়ছে। বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো চাল বিপণনে আসায় তাদের বাকিতে চাল কেনার সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছে। ফলে সংকটকালে দেশের সরবরাহ চেইনকে স্থিতিশীল রাখা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ ছাড়া ধানের উত্তোলন মৌসুমে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আলাদা করে চাল সংগ্রহ শুরু করলে চালের সংকট তৈরি হতে পারে বলেও শঙ্কা পাইকারি ব্যবসায়ীদের। গত ১০ থেকে ১২ বছর বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো চালের দাম নিয়ে কারসাজি করছে বলেও অভিযোগ তাদের।
নয়াবাজারে কথা হয় ক্রেতা আয়শা সিদ্দিকার সঙ্গে। তিনি বলেন, বৃষ্টির অজুহাতে প্রায় সবকিছুর দাম বেড়েছে ৫-১০ টাকা করে। কিন্তু কিছুর দামই কমেনি। পেঁয়াজ-চাল থেকে শুরু করে মাছ-মাংসের দামও এখন নাগালের বাইরে চলে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে জীবন ধারণ কষ্টকর হয়ে পড়বে বলেও ক্ষোভ জানান তিনি।