খামার থেকে দেশি গরুর দুধ সংগ্রহ করার পর তা গরম করে এতে সামান্য পরিমাণ চিনি ঢেলে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণে বানানো হচ্ছে সুস্বাদু ক্ষীর। মতলব ছাড়াও এখানকার তৈরি ক্ষীর বিদেশে রপ্তানি হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, মিলেছে স্বর্ণপদকও। এখন ঐতিহ্যবাহী এ ক্ষীর ব্যবসা এগিয়ে নিতে প্রশাসনও তৎপর হয়েছে। সরেজমিন মতলবের মেক্সি স্ট্যান্ড মোড়, কলেজ রোড ও ঘোষপট্টি ঘুরে ক্ষীর বানানোর এ কর্মযজ্ঞ চোখে পড়েছে।
এলাকার কলাদী গ্রামের গৃহবধূ বিউটি রানী ঘোষ। তিনি লাকড়ি জ্বালানো দাউ দাউ করা আগুনের চুলায় কড়াইয়ের মধ্যে দেশি গরুর দুধ নেড়ে গরম করছেন। এরপর দুধ অনেকটা শুকিয়ে আসতে শুরু করলে এতে সামান্য পরিমাণে তিনি চিনি ঢেলে দিচ্ছেন। এরপর আরও কিছুক্ষণ নাড়ার পর কড়াই নামিয়ে দুধ জ্বাল দিয়ে উৎপন্ন হওয়া ক্ষীর নির্দিষ্ট পাত্রে ঢালছেন। আর এমন কাজ করেই এ গৃহবধূ ২০১৮ সালে পেয়েছেন জাতীয় পল্লী উন্নয়ন পদক। সাধারণ গৃহবধূদের কাছে এখন রীতিমতো মডেল এ ক্ষীর বিক্রেতা বিউটি রানী ঘোষ। তিনি বলেন, অনেকটা চ্যালেঞ্জ নিয়েই ক্ষীর বানানোর কাজ শুরু করি। এখন দিনে চার/পাঁচ মণ দুধের ক্ষীর তৈরি করছি। আমার সফলতা দেখে অন্যান্য গৃহবধূও এখন ক্ষীর তৈরিতে আগ্রহী হচ্ছে। বিউটি রানীর স্বামী উৎপল চন্দ্র ঘোষ বলেন, আমি অন্য পেশায় থাকলেও স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় ক্ষীর বিক্রির জন্য দোকান দিয়েছি। খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ক্রেতাদের থেকে অনেক সাড়া পাচ্ছি। সৎভাবে বেঁচে থাকার পথ হিসেবে এখন এ পেশাতেই টিকে আছি।
এদিকে মতলব দক্ষিণের অন্য ক্ষীর ব্যবসায়ীরা নিজস্ব ক্ষীর তৈরির কারখানায় কারিগরের মাধ্যমেও তৈরি করছেন ক্ষীর। কেউ কেউ বাপদাদার দেখানো পেশা হিসেবে জড়িত হয়ে এখন ক্ষীর ব্যবসা নিয়ে গেছেন সাফল্যের অনন্য উচ্চতায়। একেকটি দোকান থেকে গড়ে ৩০টি করে ক্ষীরের খোড়া বিক্রি করলেও মাসে তারা আয় করছেন প্রায় লাখ টাকা। এমনকি এখানকার ক্ষীর অনলাইনে অর্ডার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশেও। আসছে বৈদেশিক মুদ্রাও।
মতলব দক্ষিণের প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্য মতে, এখানে তিনটি রেজিস্টার ডেইরি খামার ও নন-রেজিস্টার ২৮৯টি ডেইরি খামারে ৪৫০ থেকে ৫০০ খামারি দুধ উৎপাদনের কাজে জড়িত। যেখানে দুধের চাহিদা মেটাচ্ছে ৬ হাজার ২৫৪টি দেশি গাভি। এদের থেকে বছরে ০.২৩ টন অর্থাৎ ২ কোটি ৩০ লাখ লিটার দুধ পাওয়া যাচ্ছে, যা মাসে ০.০২৭ টন অর্থাৎ ২ লাখ ৭০ হাজার লিটার। জানা যায়, ক্ষীর কেন্দ্র করে মতলবের ঐতিহ্যবাহী শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেব মন্দির সংলগ্ন এলাকা, নারায়পুর বাজার, সাহেব বাজার, গাজীপুর বাজার, দগরপুর বাজার ও নায়েরগাঁও বাজারে সারি সারিভাবে বসে দুধ বেচাকেনার প্রচলন শুরু হয়। আদি গান্ধি ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারের পরিচালক সজল ঘোষ বলেন, এক কেজি দুধের দাম অনুসারে ক্ষীর ৫শ থেকে ৬শ টাকা দামে বিক্রি হয়। এক কেজি ক্ষীর বানাতে ৪ কেজি দুধ ও অল্প পরিমাণে চিনি লাগে।
মতলব দক্ষিণ যুব ঐক্য পরিষদ নেতা চন্দন বিশ্বাস বলেন, আমাদের এই মতলবে আদি গান্ধি ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার, ঘোষ কেবিন সুইটস, ভাই ভাই সুইটস অ্যান্ড মিষ্টান্ন ভান্ডার, মধুবন মিষ্টান্ন ভান্ডার, আনন্দ ক্ষীর হাউস, বৈশাখী সুইটসসহ অন্য দোকানগুলোতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্ষীর বেচাকেনা হয়। এ বিষয়ে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ থানার ওসি রিপন বালা বলেন, এই মতলবের ক্ষীর সারা দেশেই বিখ্যাত। এখানে যারা ক্ষীর ব্যবসা করছেন, আইনশৃঙ্খলাজনিত যে কোনো প্রয়োজনে তাদের পাশে সবসময় রয়েছে পুলিশ। এ বিষয়ে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতিমা সুলতানা বলেন, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন উপায়ে ক্ষীর বানাতে প্রশিক্ষণসহ স্বর্ণপদক জয়ী বিউটি রানী ঘোষ তৈরি করতে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন। মতলবের সুস্বাদু এ ক্ষীরের সুখ্যাতি সারা দেশে ছড়াতে সবসময়ই ক্ষীর ব্যবসায়ীদের পাশে থাকবে উপজেলা প্রশাসন।