

চীনের তীব্র চাপের মুখে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের সশস্ত্র সংগঠন তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) দেশটির সামরিক জান্তার সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। গত ২৭ ও ২৮ অক্টোবর চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং শহরে এ চুক্তি হয়। সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
চীনের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত দেং শিজুনের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত এই চুক্তি অনুযায়ী, টিএনএলএ মান্দালয় অঞ্চলের মোগোক শহর ও উত্তর শান রাজ্যের মংমিট শহর মিয়ানমার সেনাদের হাতে ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, জান্তা বাহিনী টিএনএলএ-নিয়ন্ত্রিত অবশিষ্ট এলাকায় আর কোনো হামলা বা বিমান অভিযান চালাবে না। গত বুধবার থেকেই এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
নিরবচ্ছিন্ন হামলা ও চীনের চাপের ফলেই অস্ত্রবিরতি: যুদ্ধবিরতির আগের কয়েক মাস ধরে মিয়ানমার সেনারা উত্তর শান রাজ্যের টিএনএলএ-নিয়ন্ত্রিত এলাকা ও মান্দালয়ের মোগোকে প্রায় প্রতিদিন বিমান হামলা চালায়, এতে বহু বেসামরিক নাগরিক নিহত ও অবকাঠামো ধ্বংস হয়।
একজন সামরিক বিশ্লেষক ইরাবতী নিউজকে বলেন, চীনের চাপ এবং জান্তার হামলা—এই দুইয়ের মিলিত প্রভাবে টিএনএলএ অবশেষে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।
ওই সামরিক বিশ্লেষক বলেন, চীনের সীমান্ত সংলগ্ন উত্তর শান রাজ্যে বেইজিংয়ের অনুমতি ছাড়া জান্তা নতুন হামলা চালাতে পারবে না। তারা চীনকে ভয় পায়, আর চীন নিজের সীমান্তের কাছে সংঘাত বরদাশত করবে না।
টিএনএলএ হলো ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সদস্য, যেখানে উত্তর শানের আরেক সশস্ত্র দল এমএনডিএএ (মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি) ও রাখাইন রাজ্যের আরাকান আর্মি (এএ) অন্তর্ভুক্ত।
এই জোট ২০২৩ সালের অক্টোবরে ‘অপারেশন ১০২৭’ নামে যৌথ সামরিক অভিযান শুরু করে। তারা চীন সীমান্ত থেকে মান্দালয় অঞ্চল পর্যন্ত বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয়, যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত বাণিজ্যপথও ছিল। তবে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে চীনের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতির পর অভিযান স্থগিত করা হয়।
পরে ২০২৪ সালের জুনে জান্তা বারবার বিমান হামলা চালিয়ে সেই চুক্তি ভঙ্গ করলে টিএনএলএ আবার লড়াই শুরু করে। তাদের সঙ্গে পিডিএফ (পিপলস ডিফেন্স ফোর্স) ও অন্যান্য প্রতিরোধ যোদ্ধারাও যোগ দেয়। টিএনএলএ দ্রুত নওংখিও, কিয়াউকমে, সিপাও ও মংমিটসহ চারটি শহর এবং মান্দালয়ের রুবি খনির শহর মোগোক দখলে নেয়। তারা সিঙ্গু, মাদায়া ও পাথেইংজি এলাকায়ও পিডিএফকে সহায়তা করে, যা মান্দালয় শহর ও পাইং ওউ লুইন সেনাঘাঁটির জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। একই সময়ে এমএনডিএএ ও তাদের মিত্ররা ২০২৪ সালের আগস্টে উত্তর শানের রাজধানী লাশিও দখল করে নেয়।
লাশিও দখলের পর চীন টিএনএলএ ও এমএনডিএএ-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর সীমান্ত বন্ধ করে দেয় এবং এসব গোষ্ঠীর সদস্যদের ওপর দমন শুরু করে। চীন সীমান্তে অবস্থিত ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মিকেও (ইউডব্লিউএসএ) নির্দেশ দেয়, যাতে তারা এমএনডিএএকে আর সাহায্য না করে।
২০২৪ সালে বেইজিং এমএনডিএএ নেতা পেং দারেনকে আটক করে চাপ বাড়ায়। এরপর এমএনডিএএ প্রকাশ্যে জানায়, তারা মান্দালয় বা টাউংগি আক্রমণ করবে না এবং চীনের বিরোধী কোনো সংগঠনের সঙ্গে কাজ করবে না। পরে চলতি বছরের এপ্রিলে তারা লাশিও শহরও জান্তার হাতে ফিরিয়ে দেয়।
জান্তার পাল্টা অভিযান ও চীনের প্রভাব: চীনের চাপ বাড়ার পর জুলাই ও অক্টোবর মাসে জান্তা বাহিনী নওংখিও, কিয়াউকমে ও সিপাও শহর পুনর্দখল করে নেয়, যা মান্দালয়-লাশিও-মিউজ মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, চীন-মিয়ানমার বাণিজ্যের মূল রুট। অবিরাম বিমান হামলা ও বেসামরিক হতাহতের ঘটনায় টিএনএলএ আরও চাপের মুখে পড়ে।
অন্যদিকে, চীনের সরাসরি প্রভাবের বাইরে থাকা আরাকান আর্মি ২০২৩ সালের নভেম্বরে পশ্চিম মিয়ানমারে অভিযান চালিয়ে রাখাইন রাজ্যের ১৭টির মধ্যে ১৪টি শহর ও চিন রাজ্যের পলেটওয়া এলাকা দখল করে নেয়।
বর্তমানে আরাকান আর্মি রাখাইনের রাজধানী সিত্তে ও কিয়াউকফিউ শহর দখলের চেষ্টা করছে, যেখানে চীনের গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ প্রকল্প, গভীর সমুদ্রবন্দর ও তেল-গ্যাস পাইপলাইনের টার্মিনাল রয়েছে, যা সরাসরি ইউনান প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত।
মন্তব্য করুন