বিশ্ববেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:২১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মিয়ানমার জান্তা যেভাবে ফের এলাকা দখল নিচ্ছে

রয়টার্সের প্রতিবেদন
মিয়ানমার জান্তা যেভাবে ফের এলাকা দখল নিচ্ছে

দুই বছর আগে বিদ্রোহীদের বড় ধরনের অভিযানে মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকার বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। এখন সেই যুদ্ধক্ষেত্রে ধীরে ধীরে অবস্থান ফিরে পাচ্ছে জান্তা। মূলত সামরিক বাহিনীর কৌশলে বড় পরিবর্তন এসেছে। বাধ্যতামূলক সেনাভর্তি, ড্রোন বহরের বিস্তার আর চীনের কূটনৈতিক ও আর্থিক সমর্থনে এসব পরিবর্তন এসেছে। এসবের জোরে পরাজয় বা অচলাবস্থার পর কিছু এলাকা ফের দখলে নিতে পেরেছে সেনাবাহিনী। বিদ্রোহী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের বরাতে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স এমন তথ্য দিয়েছে।

টানা সাত দিন ধরে অবস্থান ধরে রেখেছিলেন বিদ্রোহী যোদ্ধা খান্ত ও তার সঙ্গীরা। কিন্তু তাদের ওপর কামান আর ড্রোন দিয়ে একের পর এক আঘাত হানছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। খান্ত একজন অভিজ্ঞ যোদ্ধা। জান্তা ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখলে নেওয়ার পর থেকে তাদের বিরুদ্ধে বহু লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন তিনি। কিন্তু অক্টোবরে মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলে ওই লড়াইয়ে যে তীব্রতা দেখেছেন, তা এর আগে দেখেননি।

মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় শহর ইয়াঙ্গুন ও রাজধানী নেপিদোর প্রায় মাঝামাঝি গ্রাম পাজুন মিউংয়ে দুপক্ষের মধ্যে লড়াইটি হচ্ছিল। খান্ত ও আরেক বিদ্রোহী হটাইক জানান, গোলাবর্ষণের পর শুরু হয় একের পর এক পদাতিক বাহিনীর ঢেউ। ‘ওদের কাছে যত শক্তি ছিল, সব ঢেলে আক্রমণ চালিয়েছে’ পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলা এ কঠিন লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে বলেন হটাইক। এক সপ্তাহের মাথায় ক্ষয়ক্ষতি আর সামলানো সম্ভব হয়নি। বিদ্রোহীরা পিছু হটে কাছের একটি ঘাঁটিতে চলে যান।

মাঠে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা: দুই বছর আগে বিদ্রোহীদের বড় ধরনের অভিযানে মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকার বিশাল অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। কিন্তু রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা ছয় বিদ্রোহী যোদ্ধা ও তিন নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে, এখন সেই যুদ্ধক্ষেত্রে ধীরে ধীরে অবস্থান ফিরে পাচ্ছে জান্তা। তিন বিদ্রোহী যোদ্ধা জানান, সাম্প্রতিক লড়াইয়ে তারা সেনাদের ‘মানবঢেউ’ কৌশল ব্যবহার করতে দেখেছেন, যা আগে এভাবে দেখা যায়নি। তিনি বলেন, একজন মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন তার জায়গা নিচ্ছিল। তার দাবি, কিছু সেনাকে বন্দুক তাক করে সামনে এগিয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছিল। কিন্তু আগে ক্ষয়ক্ষতি বাড়লেই সেনারা দ্রুত পিছু হটত, জানান বিদ্রোহীরা।

রয়টার্স জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কৌশল বদলের বিষয়ে প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। জান্তাবিরোধী জাতীয় ঐক্য সরকারও এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

অসম লড়াই, কিছুটা অগ্রগতি: সিঙ্গাপুরভিত্তিক আইএসইএএস–ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটের নভেম্বরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জান্তা অন্তত তিনটি রাজ্যে সীমিত পরিসরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে অগ্রগতি অসম। বিভিন্ন এলাকায় শক্তির ভারসাম্য ভিন্ন হওয়ায় দেশজুড়ে একক কোনো পক্ষের আধিপত্য নেই।

এই পাল্টা আক্রমণের সময়ই সামনে ২৮ ডিসেম্বর থেকে মিয়ানমারে শুরু হতে যাচ্ছে সাধারণ নির্বাচন, যা জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, সুষ্ঠু হবে না। নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী অং সান সু চিসহ প্রধান বিরোধী নেতারা কারাগারে আর অনেক দল ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে।

মিয়ানমার ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির প্রধান মিন জাও বলছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে গতি বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে জান্তা আরও এলাকা দখলের চেষ্টা করবে।

সেনা ভর্তি আর ড্রোনের দাপট: ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে জান্তা তরুণদের জন্য সামরিক বাহিনীতে কাজ করা বাধ্যতামূলক করে। বিদ্রোহীদের সমন্বিত এক বড় হামলার ধাক্কার কয়েক মাস পরই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

পালিয়ে আসা দুই সেনাসদস্য ও এক বিশ্লেষকের হিসাব অনুযায়ী, এরপর ৭০ থেকে ৮০ হাজার নতুন সদস্য সেনাবাহিনীতে ঢুকেছে। প্রতি দফায় প্রায় পাঁচ হাজার করে সেনা নেওয়ার কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ২০২৫ সালের হিসাব বলছে, বর্তমানে মিয়ানমারের সেনাসংখ্যা কমে প্রায় ১ লাখ ৩৪ হাজারে দাঁড়িয়েছে, অভ্যুত্থানের আগে যা ছিল চার লাখ।

নতুন ইউনিটগুলোয় এখন অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নেতৃত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিদ্রোহীরা এক মাসে প্রায় ১৫০টি সেনা চৌকি দখল করার পর কমান্ড কাঠামোয় বড় ধরনের রদবদল হয়। একই সঙ্গে বেড়েছে ড্রোনের ব্যবহার। চীন, রাশিয়া ও ইরানে তৈরি অন্তত ১৯ ধরনের ড্রোন সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে বলে জানিয়েছে আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্ট (এসিএলইডি) ।

বিশ্লেষক সু মন, এই ২০২৫ সালেও সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত যুদ্ধ কৌশল বিমান হামলা হলেও এখন তা চালানো হচ্ছে নজরদারি ড্রোনের তথ্যের ভিত্তিতে, ফলে হামলা আরও নিখুঁত হয়েছে। বিদ্রোহীদের কাছেও ড্রোন আছে, তবে জ্যামিং প্রযুক্তি ও আকাশ প্রতিরক্ষা না থাকায় তারা পিছিয়ে পড়ছেন।

বেইজিংয়ের ভূমিকা: এই পাল্টা অভিযানের আরেক বড় চালিকা শক্তি চীন। বেইজিং ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের সেনাশাসকদের তার সীমান্ত সংলগ্ন দেশটির স্থিতিশীলতার রক্ষক হিসেবে দেখে। ২০২৪ ও ২০২৫ সালে চীনের মধ্যস্থতায় অন্তত দুটি যুদ্ধবিরতি হয়েছে, যার একটির ফলে উত্তরপূর্বের লাশিও শহর আবার জান্তার নিয়ন্ত্রণে আসে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে চীন ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে চাপ দিচ্ছে। চাপ বৃদ্ধি করতে তারা এসব গোষ্ঠীর সম্পদ জব্দ ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কঠোর করেছে।

রুবি খনির শহর মোগোকে চীনের মিত্র আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির অস্ত্র ও অর্থের জোগানে বেইজিং বিধিনিষেধ আরোপ করায় তাদের জান্তাবিরোধী প্রতিরোধ অভিযান পুরোপুরি বন্ধ আছে বলে জানান স্থানীয় বিদ্রোহী সানাই। তিনি বলেন, ‘একদিকে সামরিক পরিষদ শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে হামলা চালাচ্ছে আর আমরা পিছিয়ে পড়ছি, এর মূল কারণ শেষ পর্যন্ত চীনের চাপ।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রেম-বিয়ে নিয়ে বিরোধ, বাবাকে পিটিয়ে হত্যা

স্কয়ার গ্রুপে চাকরির সুযোগ

রাজাকার ইস্যুতে হেফাজতে ইসলামের বিবৃতি

নরসিংদীতে ১৭ দিনে ৭ খুন, বাড়চ্ছে উদ্বেগ

নতুন অতিথি আসছে নাগা-শোভিতার সংসারে, গুজন নাকি সত্যি?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নতুন নির্দেশনা ইসির

অবস ও গাইনি স্পেশালিস্ট পদে চাকরি দিচ্ছে রেড ক্রিসেন্ট

কেরানীগঞ্জে অস্ত্র-ককটেলসহ চার ডাকাত গ্রেপ্তার

রাজধানীর যেসব স্থানে বসছে ডিএমপির চেকপোস্ট

ইউক্রেন নিয়ে জার্মানির নতুন পরিকল্পনা

১০

অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে হামলাকারীর পরিচয় নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য

১১

দেশের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

১২

মহাসড়কে ভারতীয় ২ তরুণের কাণ্ড

১৩

নাশকতার দুই মামলায় মির্জা আব্বাস-আমানসহ ৪৫ জনকে অব্যাহতি 

১৪

‘মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন’ কর্মসূচিতে পুলিশের বাধা

১৫

বিএনপিতে যোগ দিলেন সাবেক জামায়াত নেতা

১৬

আপনারা মৃত্যু ঘোষণা করলেই মরে যাওয়ার চেষ্টা করব : নচিকেতা

১৭

বাংলাদেশকে উচিত শিক্ষা দেবে ভারত : আসামের মুখ্যমন্ত্রী

১৮

এলাকার সবার কাছে প্রিয় শরিফ ওসমান হাদি

১৯

খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের নিরাপত্তা টিমের প্রধান শামসুল ইসলাম

২০
X