সিরিয়ায় দুই যুগ ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখা স্বৈরাচারের তকমা পাওয়া বাশার আল আসাদ শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী বাহিনী ও জনতার রোষে পড়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ২০১১ সালে দেশটিতে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধও বেশ শক্তভাবে সামাল দেন তিনি। তাকে টিকিয়ে রাখতে সে সময় মিত্রদেশ রাশিয়া ও ইরান সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু এবার কী এমন হলো যে, বিদ্রোহীদের মাত্র কয়েক দিনের আকস্মিক হামলায় একের পর এক শহরের পতনের পর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল বাশার আল আসাদ সরকারের প্রশাসন। তবে কি ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া ও ইরান থেকে শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে যথেষ্ট সমর্থন পাননি বাশার আল আসাদ।
প্রেসিডেন্ট বাশারকে যে এভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে, তা তিনি তো বটেই খোদ দেশটির জনগণও বোধহয় কিছুদিন আগে ধারণা করতে পারেনি। কারণ সবকিছুই বেশ স্বাভাবিকভাবে চলছিল। কিন্তু সম্প্রতি বাশার আল আসাদের সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে আকস্মিকভাবে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের (আলেপ্পো ও হামা) নিয়ন্ত্রণ নেন বিদ্রোহীরা। পরে কৌশলগত হোমসসহ অন্যান্য শহরেরও নিয়ন্ত্রণ নেয়। বেশ কিছু সরকারি সেনা পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে প্রতিবেশী দেশ ইরাকে গিয়ে আশ্রয় নেন। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নেতৃত্বে থাকা হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি বলেছেন, কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে উৎখাত করাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। আর এ কথা ঘোষণার দুদিনের মধ্যে গতকাল রোববার প্রায় বিনা বাধায় রাজধানী দামেস্কে ঢুকে পড়ে বিদ্রোহী সেনারা। নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় সরকারি সব ভবনের। এরই মধ্যে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে করে দেশ ছেড়ে অজানা গন্তব্যে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। রাশিয়া অবশ্য এক বিবৃতিতে বলছে, দেশ ছাড়ার আগে বাশার আল আসাদ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে আলোচনার ভিত্তিতে তিনি প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করে সিরিয়া ছাড়তে সম্মত হন। তিনি বৈঠকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাশার প্রশাসনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ ঘাজি আল জালালি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি সরকারি সম্পদ নষ্ট করা থেকে সবাইকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। বিদ্রোহীদের কমান্ডার আল জোলানিও সবাইকে এ ধরনের বার্তা দিয়েছেন। বাশার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর সিরিয়ায় নতুন যুগের শুরু হয়েছে বলে বিদ্রোহী সেনাদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে। বাশারমুক্ত সিরিয়ায় শুরু হয়েছে আনন্দ উদযাপন। বিদ্রোহী সেনাদের সঙ্গে রাজপথে নারী শিশুসহ সব বয়সী মানুষ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে।
এদিকে এতদিন শক্তভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখলেও কেন ১২ দিনের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে পতন হলো বাশার সরকারের, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এরই মধ্যে বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা হুগো বাচেগা এক বিশ্লেষণে বলেন, ২০১১ সালে বিরোধীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ নৃশংসভাবে দমন করার কারণে আসাদকে সিরিয়ার মানুষ চিরকাল মনে রাখবে। কারণ, এরপরই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই যুদ্ধে ৫ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়। এ ছাড়া আরও ৬০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থী হয়। রাশিয়া ও ইরানের সমর্থনে বাশার বিদ্রোহ গুঁড়িয়ে দিয়ে এতদিন ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। রাশিয়া তার প্রতাপশালী বিমানবাহিনী ব্যবহার করেছে, ইরান সামরিক উপদেষ্টা পাঠিয়েছে। আর প্রতিবেশী লেবাননের হিজবুল্লাহ সশস্ত্র গোষ্ঠী তাদের প্রশিক্ষিত যোদ্ধা পাঠিয়েছে আসাদ বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য। মূলত এ তিন শক্তিশালী মিত্রের সহযোগিতার কারণে ২০১১ সালের বিদ্রোহ সামাল দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিলেন বাশার। কিন্তু এবার মিত্রদের তেমন কোনো1 সহায়তাই পায়নি আসাদ সরকার। কারণ মিত্ররা তাদের নিজেদের সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত এখন। রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর সেখানে যুদ্ধ করছে। গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে গত বছর হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়, যা এখনো চলছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানেরও পাল্টাপাল্টি কিছু হামলা হয়েছে। এরপর ইরান ইসরায়েলকে মোকাবিলা করা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সিরিয়ায় নতুন সংঘাতে সরাসরি জড়াতে চায়নি। মিত্রদের সহায়তা না পাওয়ায় ইসলামপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যত কোথাও কোথাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি আসাদের সেনারা। আবার কোথাও কোথাও বাধা না দিয়ে তারা পালিয়ে গেছে।
গত সপ্তাহে বিদ্রোহী বাহিনী কোনো রকম প্রতিরোধের মুখে না পড়েই প্রথমে সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী আলেপ্পো দখল করে নেয়। তারপর হামা এবং কয়েক দিন পর হোমস নগরী দখল করে নেওয়ায় রাজধানী দামেস্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দামেস্ক দখল করে নিতে তাদের বেগ পেতে হয়নি। বিদ্রোহী যোদ্ধারা দামেস্কে ঢোকার সময়ই ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে সিরিয়া ছেড়ে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। এর মধ্য দিয়ে আসাদ পরিবারের ৫ দশকের শাসনের ইতি ঘটে।
বিবিসির হুগো বাচেগার মতে, এ তিন গুরুত্বপূর্ণ মিত্র আগের মতো পূর্ণ সহযোগিতা করতে না পারায় মূলত বাশার সরকার হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। তার মতে, বাশারের ক্ষমতাচ্যুতি শুধু সিরিয়াতেই ব্যাপক পরিবর্তন আনবে না, মধ্যপ্রাচ্যেও ক্ষমতার ভারসাম্য এখন নতুন রূপ পাবে। কারণ আসাদের সময় ইরান ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যোগাযোগের অংশ ছিল সিরিয়া। হিজবুল্লাহকে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহের ক্ষেত্রে সিরিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসরায়েলের সঙ্গে প্রায় এক বছর ধরে যুদ্ধে হিজবুল্লাহও দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং তাদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। ইরান সমর্থিত ইয়েমেনের হুতি যোদ্ধারাও বারবার বিমান হামলার শিকার হয়েছে। ইরাকের মিলিশিয়া ও গাজার হামাস যোদ্ধাসহ এসব গোষ্ঠীকে ইরান প্রতিরোধের অক্ষ মনে করে, যারা এখন ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন। ইরানের মিত্রদের এমন বিপর্যয় ইসরায়েল উদযাপন করতেই পারে, কারণ তারা ইরানকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে। সিরিয়ায় বিদ্রোহী বাহিনীর এ বিজয় তুরস্কের আশীর্বাদ ছাড়া সম্ভব হতো না বলে মনে করেন অনেকে। কারণ দেশটি সিরিয়ার কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন করে। তবে তুরস্ক হায়াত তাহরিরকে সহায়তা করার কথা অস্বীকার করেছে।