চাঁদপুর ও হাইমচর প্রতিনিধি
চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার মেঘনা নদীর ইশানবালা খালের মুখে নোঙর করা ‘এমভি আল-বাখেরা’ জাহাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ৮ জনের রক্তাক্ত দেহ। কারও গলা কাটা, কারও মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন। গতকাল সোমবার দুপুরের পর পুলিশ সেই জাহাজে গিয়ে পাঁচজনকে মৃত অবস্থায় পায়। ৩ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত্যু হয় আরও দুজনের। গলাকাটা অবস্থায় চিকিৎসা চলছে আরও একজনের। তারা আটজনই জাহাজটির কর্মী।
পুলিশ ও জাহাজ মালিক সূত্র জানিয়েছে, জাহাজটি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর কাফকো জেটি থেকে ৭২০ টন ইউরিয়া সার নিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীর দিকে যাচ্ছিল। এই সার ছিল বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি)। সারবোঝাই জাহাজে কেন এই নৃশংসতা—তা নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ বা জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষ। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, সার লুটের জন্য ডাকাত দল এই নৃশংসতা চালাতে পারে, পূর্বশত্রুতার ফলেও হতে পারে এমন ঘটনা। তবে গুরুত্বপূর্ণ এই নৌরুটে এ ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে নিরাপত্তা নিয়েও।
প্রাথমিকভাবে নৌ পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও হাসপাতাল সূত্রে হতাহতের মধ্যে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছয়জনের পরিচয় মিলেছে। তারা হলেন—জাহাজটির মাস্টার কিবরিয়া, চালক সালাউদ্দিন, সুকানি আমিনুল মুন্সী, গ্রিজার সজিবুল ইসলাম, গ্রিজার আজিজুল ও লস্কর মাজেদুল। তাদের মরদেহ চাঁদপুর হাসপাতাল মর্গে রয়েছে। এ ছাড়া রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে সুকানি মো. জুয়েলকে প্রথমে চাঁদপুর হাসপাতাল ও পরে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। তার গলা কাটা রয়েছে। তাদের সবার বাড়ি ফরিদপুর, শেরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বলে জানা গেছে।
চাঁদপুর জেলা পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুর রকিব কালবেলাকে বলেন, জাহাজটি সারবোঝাই ছিল। সার লুটের জন্য ডাকাত দল সেখানে আক্রমণ করে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে। তবে সেখান থেকে সার লুট হয়েছে কি না, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিষয়টি মালিকপক্ষকে নিয়ে যাচাই করা হচ্ছে। তা ছাড়া পূর্বের কোনো শত্রুতা নিয়েও এমন ঘটনা ঘটতে পারে।
পুলিশ সুপার বলেন, প্রযুক্তি ও কৌশলগত বিভিন্ন দিক মাথায় রেখে তদন্ত চলছে। থানা পুলিশের পাশাপাশি নৌ পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থাও ঘটনার তদন্তে নেমেছে।
যেভাবে নোঙর করা জাহাজে মিলল এত লাশ: জাহাজের মালিক দিপলু রানা বলেন, সোমবার সকালে ‘এমভি আল-বাখেরা’ জাহাজে যোগাযোগ করেও কারও সাড়া না মেলায় তিনি চিন্তায় পড়ে যান। এরপর আমাদের আরেকটি জাহাজ মুগনি-৩ নাবিকদের বিষয়টি জানান তিনি। ওই জাহাজ এমভি আল-বাখেরার কাছাকাছি ছিল। তারা আল-বাখেরার কাছাকাছি যাওয়ার পরই জাহাজের ভেতর কর্মীদের রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন।
মুগনি-৩ জাহাজের চালক মোহাম্মদ বাচ্চু মিয়া জানান, তারা খালি জাহাজ নিয়ে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন। মালিকের ফোন পেয়ে দুপুর ১টার দিকে তারা এমভি আল-বাখেরা জাহাজের কাছাকাছি যান। সুকানি রবিউল এমভি আল-বাখেরা জাহাজে উঠে রক্তাক্ত অবস্থায় কয়েকজনকে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার দেন। এরপর মুগনি-৩ থেকে আরও কয়েকজন ওই জাহাজে ওঠেন। তখন সবাইকেই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে পাঁচজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় আরও তিনজন পড়ে ছিলেন। দ্রুত বিষয়টি মালিক ও পুলিশকে জানানো হয়। তখন পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে।
নৌ পুলিশের চাঁদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ মুশফিকুর রহমান জানিয়েছেন, জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে নৌ পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং ৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করে। তিনজনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠালেও আরও দুজন মারা যান।
চাঁদপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার আনিসুর রহমান বলেন, যে তিনজনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে, তাদের মধ্যে দুজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ওই দুজনের মাথায় ও শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। এ ছাড়া উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো ব্যক্তির গলার বেশির ভাগ কাটা ছিল। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তবে সে নিজে কাগজে লিখে নাম জানিয়েছে যে তার নাম জুয়েল।
কখন খুন করা হয় ৭ জনকে: পুলিশ ও জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষ ধারণা করছে, রোববার রাত সাড়ে ৮টার পর থেকে গতকাল সোমবার সকালে মধ্যে জাহাজের ভেতর ওই সাতজনকে হত্যা করা হতে পারে। কারণ জাহাজ মালিক গত রোববার রাত সাড়ে ৮টার দিকেও সেখানে থাকা কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
এমভি আল-বাখেরা জাহাজের মালিক দিপলু রানা জানিয়েছেন, জাহাজে থাকা চালকের সঙ্গে রোববার রাত সাড়ে ৮টার দিকে কথা হয় তার। তখন চালক জানিয়েছিলেন, মেঘনা নদীতে তারা জাহাজের বহরের মধ্যে রয়েছেন। তবে সোমবার (গতকাল) সকালে কেউ ফোন ধরেননি। এ নিয়ে তিনি চিন্তায় পড়ে যান। এরপর তার মালিকানাধীন অন্য একটি জাহাজকে ওই রুটে খোঁজ নিতে পাঠান।
কেন এমন নৃশংসতা হতে পারে, জানতে চাইলে জাহাজ মালিক বলেন, তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। কারা কেন এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, তা পুলিশ তদন্ত করে বের করবে।
এদিকে চাঁদপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, প্রতিনিয়ত মেঘনা নদীর ওই রুটে কোটি কোটি টাকার পণ্য জাহাজে করে আনা-নেওয়া হয়। তাই এই নৌপথে এমন ঘটনায় নিরাপত্তা ঘাটতি ছিল এবং তা জোরদার করতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দ্রুত এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে কাজ শুরু হয়েছে।
এদিকে লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল জানায়, ১৯ ডিসেম্বর ৮০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার আল-বাখেরা নামের জাহাজটি ইউরিয়া সার পরিবহনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। জাহাজটির পণ্য পরিবহন ঠিকাদার মেসার্স হামিদিয়া এন্টারপ্রাইজ। বরাদ্দ পাওয়ার পর জাহাজটিতে ২১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর কাফকো জেটি থেকে ৭২০ টন ইউরিয়া সার বোঝাই করা হয়। গত রোববার ভোরে জাহাজটি সার নিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীর উদ্দেশে রওনা হয়।
জাহাজটিতে বহন করা পণ্যের এজেন্ট হামিদিয়া এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক (পরিচালন) পারভেজ হোসাইন বলেন, জাহাজ গন্তব্যে রওনা হওয়ার পর তারা নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। সকাল থেকে যোগাযোগ বন্ধ থাকায় মূলত মুগনি-৩ জাহাজের নাবিকরা এমভি আল-বাখেরার কাছাকাছি গিয়ে ঘটনা জানতে পারেন।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি: জাহাজে ডাকাতের আক্রমণ ও আট কর্মী হত্যার ঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক এবং যুগ্ম সচিবকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। পাঁচ কার্য দিবসের মধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। শিল্প মন্ত্রণালয় এ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে।