ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য গত ১৩ বছরে সরকারের বরাদ্দ ছিল ৭৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত (২০২২-২৩) অর্থবছর পর্যন্ত ১৪ হাজার ৭০৭ জনের পুনর্বাসনে ব্যয় হয়েছে ৪২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। প্রতিবছর এই কর্মসূচির জন্য বাজেটে বরাদ্দ থাকলেও বিপুলসংখ্যক মানুষকে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে মুক্তি দিতে প্রয়োজনের তুলনায় এই অর্থ ‘একমুঠো ভিক্ষা’ ছাড়া আর কিছুই না। এ কারণেই দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা কমছে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. আবুল বারকাত কালবেলাকে বলেন, ‘নিঃসন্দেহে দারিদ্র্যের কারণে দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়ছে। দারিদ্র্যের কারণগুলোর মধ্যে প্রধান কারণ বৈষম্য—জনবৈষম্য, ধনবৈষম্য, আয়বৈষম্য, স্বাস্থ্যবৈষম্য, শিক্ষাবৈষম্য, আবাসন বৈষম্য। এসব বৈষম্য হ্রাস না করলে দারিদ্র্য বাড়বে। দারিদ্র্য বাড়লে ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়বে। এজন্য সব ধরনের বৈষম্য কমাতে হবে।’
সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে ২০১০ সালে ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ শীর্ষক কর্মসূচি চালু করা হয়। তবে শুরুতে এই কার্যক্রম ছিল একেবারেই সীমিত পরিসরে। ২০১০-১১ অর্থবছরে এই কর্মসূচির জন্য ৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। তবে ব্যয় করা হয় মাত্র ১৮ লাখ টাকা। পরের ৬ বছরও এই কর্মসূচির চিত্র অনেকটা একই রকম ছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য প্রথমবারের মতো দেশের ৫৮টি জেলায় অর্থ দেওয়া হয়। তখন থেকে প্রতিবছরই এ খাতে বরাদ্দ ও ব্যয় বেড়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, গত ১৩ অর্থবছরে (২০১০-১১ থেকে ২০২২-২৩) ভিক্ষুক পুনর্বাসন বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭৫ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৪২ কোটি ৬৪ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। গত অর্থবছরে এই কর্মসূচিতে ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও প্রকৃত ব্যয় কত ছিল—সেই হিসাব পাওয়া যায়নি।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় পরিচালিত এই কর্মসূচির উপপরিচালক মো. শাহজাহান কালবেলাকে জানান, ঢাকার মিরপুর, নারায়ণগঞ্জের বেতিলা, গাজীপুরের কাশিমপুর ও পুবাইল জমিদারবাড়ি, ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধলা এবং মানিকগঞ্জের পুরোনো জমিদারবাড়িতে সরকারি ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন করা হয়। সরকারিভাবে ১ হাজার ৭০০ ভবঘুরেকে এই আশ্রয়কেন্দ্রে রাখার কথা। তবে পুরোনো জমিদারবাড়িগুলো সংস্কারের অভাবে ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় বর্তমানে এসব আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় এক হাজার ভবঘুরেকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
জানা গেছে, গত (২০২১-২২) অর্থবছরে ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ২৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ওই বছর ৬৩টি জেলায় অর্থ পাঠানোর পাশাপাশি মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে আটক ভিক্ষুকদের আশ্রয়ের জন্য ১৬টি ডরমিটরি নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ ছিল। সে অনুযায়ী দেশের ৫টি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রের ভেতরে ফাঁকা জায়গায় অস্থায়ী ভিত্তিতে টিনশেড ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধলায় ৬টি, গাজীপুরে কাশিমপুর ও পুবাইলে ৪টি করে ৮টি, নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল এবং ঢাকার মিরপুরে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে একটি করে ডরমিটরি নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হলেও রাস্তা এবং কিছু কাজ এখনো বাকি আছে। তার আগেই বরাদ্দ অর্থের মধ্যে ২৬ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়ে গেছে।
সরেজমিন জানা যায়, ময়মনসিংহের ত্রিশালের ধলায় সরকারি খালি জায়গায় ভিক্ষুকদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ৬টি ভবন। প্রতিটি টিনশেড ভবনে রয়েছে একটি অফিস কক্ষ, বারান্দা, দুটি স্নানাগার, দুটি পায়খানা ও দুটি বেসিন। ভবনগুলোর কাজ শেষ হলেও উদ্বোধন হয়নি। এরই মধ্যে বৃষ্টিতে কক্ষগুলোর সামনের ও পেছনের মাটি সরে গেছে।
এই আশ্রয়কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ রেদোয়ান হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রের পুনর্বাসনে ৬টি টিনশেড ভবনের নির্মাণকাজ প্রায় সম্পন্ন। ভেতর ও বাইরের রাস্তার কাজ শেষ হলেই এগুলো উদ্বোধন করা হবে।’
ময়মনসিংহ সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক আ. কাইয়ুম কালবেলাকে জানান, ‘৬টি টিনশেড ডরমিটরি ভবন নির্মাণের জন্য ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে ব্য়য় হয়েছে ৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এখানে প্রতিটি কক্ষে ৫০ জন করে ৩০০ ভিক্ষুক থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।’
তিনি আরও জানান, ‘পুরুষ ভিক্ষুকদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। যাদের দেখাশোনার কেউ নেই, তারাই শুধু এখানে থাকবেন। যার আত্মীয়স্বজন আছে, তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে পুনর্বাসন করা হবে।’
এদিকে ঢাকা শহরে ভিক্ষাবৃত্তি রোধের জন্য প্রাথমিকভাবে সিটি করপোরেশন শহরের কিছু এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করে। এলাকাগুলো হলো বিমানবন্দরে প্রবেশপথের পূর্ব পাশের চৌরাস্তা, বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ি ও এর আশপাশ এলাকা, হোটেল র্যাডিসন সংলগ্ন এলাকা, ভিআইপি রোড, বেইলি রোড, হোটেল সোনারগাঁও ও হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল সংলগ্ন এলাকা, রবীন্দ্র সরণি এবং কূটনৈতিক জোনগুলো। কিন্তু সরেজমিন এসব এলাকায় এখনো ভিক্ষুকের আনাগোনা দেখা গেছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩০টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে ২ হাজার ৬০০ জন ভিক্ষুকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৮০৫ জনকে ভিক্ষাবৃত্তি না করার শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়। বাকি ৭৯৫ জনকে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ সত্ত্বেও ঢাকায় ভিক্ষাবৃত্তি থেমে নেই। বরং দিন দিন ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ভিক্ষুকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদীভাঙন, উপকূলীয় এলাকার মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে বাস্তুহারা হয়ে বাঁচার তাগিদে শহরমুখী হচ্ছে। কেউ ঠাঁই নিয়েছে বস্তিতে, কেউ ফুটপাতে, কেউ বা রেলস্টেশন বা লঞ্চঘাটে। অনেকে কাজ না পেয়ে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে।
কমফোর্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের উল্টো দিকে কম্বল গায়ে জড়িয়ে ফুটপাতে বসে ভিক্ষা করছিলেন কমলা নামে এক নারী। তার সামনে ছোট্ট একটি পাত্রে ২, ৫, ১০ টাকার কয়েকটি নোট। সামনে দিয়ে কেউ গেলে দুই হাত বাড়িয়ে ভিক্ষা চাইছিলেন তিনি। তার সঙ্গে কথা বলতেই জানা গেল, ১০ বছর বয়সে সাত ভাইবোনকে নিয়ে ঢাকায় এসে বাসাবাড়িতে কাজ শুরু করেছিলেন তার মা। একে একে সাত ভাই কোথায় হারিয়ে গেছে, বলতে পারেন না তিনি। বিয়ে হয়েছিল, সন্তানও ছিল। একদিন স্বামীও তাকে ছেড়ে চলে যায়। সন্তান কোথায় চলে গেছে জানেন না। বাসাবাড়িতে কাজ করে খেতেন। বয়স হওয়ায় কাজ করতে না পারায় এখন তার জায়গা হয়েছে ফুটপাতে।
বসুন্ধরা সিটির বিপরীত পাশের ফুটপাতে থালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী একটি মেয়ে। তার শরীরে লাগানো যন্ত্রে বাজতে থাকে ধর্মীয় গান। পরিবারের সদস্যরা তাকে সকালে এখানে রেখে যান আর সন্ধ্যা নামার আগে ফিরিয়ে নিয়ে যান। মাঝে দুবার খাবার খাইয়ে যান তারা। আশপাশের বস্তিতেই বাস করেন তারা। জানা গেল, এই ভিক্ষার টাকায় চলে পুরো পরিবার।
ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান নীতিমালায় পুনর্বাসন সহায়তায় বলা হয়েছে, ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত ব্যক্তির কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক উপার্জনমুখী কাজে পুঁজি সরবরাহের এককালীন অনুদান দেওয়া, পুনর্বাসনের লক্ষ্যে দক্ষতা ও উপার্জনমুখী প্রশিক্ষণ, সহায়ক উপকরণ সরবরাহ করা হবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থায় ক্ষুদ্র ব্যবসা, মুদি দোকান, চায়ের দোকান, পানের দোকান, কাঁচামালের ব্যবসা, বাদাম বিক্রি, রিকশা-ভ্যানচালক ইত্যাদি।
তবে এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে যত জনকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে, দেশে ভিক্ষুকের মোট সংখ্যা ও নতুন করে ভিক্ষাবৃত্তিতে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা তার চেয়ে অনেক বেশি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচির ২০১৭ সালের এক জরিপে জানা যায়, দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা আনুমানিক ২ লাখ ৫০ হাজার। এরপর ভিক্ষুকের সংখ্যা নিরূপণে আর কোনো জরিপ করা হয়নি।
সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে কোনো কর্মসূচি নেওয়া হলে তার মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হবে না। এজন্য ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা নিতে হবে। বর্তমানে যারা ভিক্ষা করছে তাদের স্থায়ী পুনর্বাসনের পাশাপাশি নতুন করে কেউ যাতে এ কাজে যুক্ত না হয়, সেজন্য দারিদ্র্য নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে এর বিপরীতে মজুরি বাড়াতে হবে। তা না হলে মানুষ দরিদ্র হবে। সেটাও ভিক্ষুকে রূপান্তরিত হওয়ার পক্ষে একটা বড় ধরনের প্রভাব হিসেবে কাজ করে। শুধু পুনর্বাসন কর্মসূচি দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করা যাবে না। প্রতিটি মানুষের জন্য সব রকম মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে হবে।’
মন্তব্য করুন