বিদ্যুৎ খাতে লোকসান কমাতে ভর্তুকি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী তিন অর্থবছরে পর্যায়ক্রমে ভর্তুকি কমাতে একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ও খুচরা মূল্যের ব্যবধান কমে আসবে। রোডম্যাপ অনুযায়ী, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ৬২ হাজার কোটি টাকা থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হবে। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে ভর্তুকি ৩৫ হাজার কোটি টাকা রাখা হলেও আরও ২ হাজার কোটি টাকা বাড়বে। তবে ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান কালবেলাকে বলেন, ‘লোকসান কমাতে হলে ভর্তুকি কমাতে হবে। বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি পর্যালোচনা এবং খাতভিত্তিক সংস্কারের মাধ্যমে ভর্তুকি কমানোর সুযোগ আছে। আমরা সেটিই চেষ্টা করছি।’
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ভর্তুকি কমাতে এরই মধ্যে ব্যয় সাশ্রয়ী বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর অন্যতম হলো ভারতে আদানি পাওয়ারের সঙ্গে কয়লার মূল্য পুনর্নির্ধারণ। দেশের অন্যান্য কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে সরবরাহকৃত কয়লার দাম আরও কম। কর্মকর্তারা মনে করছেন, আদানির কয়লার দাম পুনর্নির্ধারণ করে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় করা সম্ভব।
এ ছাড়া তিনটি যৌথ উদ্যোগের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র—বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি, বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি ও আরপিসিএল-নোরিঙ্কো পাওয়ার প্লান্টকে তাদের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) পর্যালোচনা করে অসংগতিগুলো দূর করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল), আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড (এপিএসসিএল), ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (ইজিসিবি), রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) এবং বি-আর পাওয়ারজেন লিমিটেডের (বিআরপিএল) অধীনে থাকা ২৩টি রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের পিপিএ পুনরায় মূল্যায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখানে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় হবে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।
কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। জ্বালানি তেলভিত্তিক কেন্দ্র কম চালানো হবে। এখানে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি ৬৮২ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়েকটি ভাড়াভিত্তিক ও আইপিপি (ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার) কেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর ফলে মোট ক্যাপাসিটি চার্জ কমে আসবে। পাশাপাশি পিডিবিকে ৩৭০ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ খরচ কমানোরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, আমদানি করা বিদ্যুতের বিলে ১ শতাংশ ছাড় নিশ্চিত করা, ইনভয়েস জমার ৩০ দিনের মধ্যে পরিশোধের মধ্য দিয়ে ৬৫ কোটি টাকা, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফার্নেস অয়েল আমদানির ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের বিষয়টি নিরুৎসাহিত করে আমদানি শুল্ক ৭ শতাংশ সাশ্রয়, বড় জাহাজে ফার্নেস অয়েল আমদানি করা, বেসরকারি খাতে ফার্নেস অয়েল আমদানির প্রণোদনা ৯ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে কমানোর মাধ্যমে ভর্তুকি কমিয়ে আনা হবে।
এ ছাড়া অভিজাত এলাকায় বিদ্যুতের বিল বাড়ানোর বিষয়টিও অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে ভর্তুকির তুলনায় ৪৭ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ হয় ক্যাপাসিটি চার্জের কারণে। যার পরিমাণ ১০ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ভর্তুকি দিতে হয় ৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। সে অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ১৩ হাজার ২১ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভর্তুকি ছিল ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, আর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভর্তুকি ছিল ২৯ হাজার ৫১১ কোটি টাকা, আর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ভর্তুকির ৬০ দশমিক ২৮ শতাংশ খরচ হয় ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পিডিবি ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করেছে ২৮ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা, আর ভর্তুকি পেয়েছে ৩৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ভর্তুকির ৭২ দশমিক ৩০ শতাংশ গেছে ক্যাপাসিটি চার্জে।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, চলতি অর্থবছরও ভর্তুকির সিংহভাগ অংশ ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতেই চলে যাবে।
মন্তব্য করুন