যে কোনো দেশের সবচেয়ে সংবেদনশীল নাগরিক বলা হয় নারী ও শিশুদের। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও নারী ও শিশুদের ওপর আক্রমণ না করার জন্য রয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নীতিমালা। বাংলাদেশের আইনেও নারী ও শিশু নির্যাতনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। তাদের সুরক্ষায় রয়েছে বিশেষ আইন। এ ধরনের অপরাধের বিচার মাত্র ১৮০ দিনের মধ্যে নিশ্চিত করারও বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে আইনে। তবে এতসব আয়োজন সবই বৃথা। এসব আইন-নীতিমালা কোনো কিছুই কাজে আসছে না। বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত সহিংসতার শিকার হচ্ছে নারী ও শিশুরা। ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে এই সহিংসতার হার। এমনকি ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন হলেও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি নারী ও শিশুদের। উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতন। শিশু ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণের পর হত্যার মতো ঘটনা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। দেশের ভেতরকার সহিংসতার হিসাব রাখে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংস্থাটির গত ১০ (আগস্ট থেকে মে) মাসের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে এমন চিত্র।
আসকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, হাসিনা সরকারের পতনের পরে গত ১১ মাসে নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৫২১ জন। যার মধ্যে ২২৮ জন শিশু ধর্ষণ এবং ৩৭ শিশু সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। একই সময়ে ১৬০ জন নারী ধর্ষণ এবং ৯৬ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যা প্রতি মাসে গড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনরেও বেশি। গত ১০ মাসে (জুলাই থেকে এপ্রিল) পর্যন্ত সময়ে হত্যার শিকার হয়েছে ৪৮৫ জন শিশু, যা গড়ে প্রতি মাসে দাঁড়ায় ৮৫ জনেরও বেশি।
এসব পরিসংখ্যান অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহ নাভিলা কাশফি কালবেলাকে বলেন, ‘এই পরিসংখ্যানগুলোই বলে দিচ্ছে সরকার নারীদের সুরক্ষার ব্যাপারে উদাসীন। একটি জাতির অর্ধেক নারী। বিরাট এই নারী জনগোষ্ঠীকে অস্বীকার করে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই উন্নয়নের শিখরে পৌঁছানো সম্ভব নয়। সংস্কার তো নয়ই। রাষ্ট্রের এই উদাসীনতা যেমন বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষদের অপরাধ প্রবণতাকে বাড়াচ্ছে, তেমনি বিরাট এই জনগোষ্ঠী মানসিক ট্রমাটাইজড হয়ে অনেকাংশে সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইনে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও, তা অনেকাংশে হয় না। অনেক ক্ষেত্রে ডিএনএ রিপোর্ট পেতে দেরি হয়। ফলে দীর্ঘায়িত হয় তদন্ত প্রক্রিয়া। সে ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষাগুলা যেন দ্রুত হয়—সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া শুধু মামলাই নয়, মামলা যেন দ্রুত শেষ হয় আর সাজা নিশ্চিত হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। পাশাপাশি ধর্ষকদের জামিন যেন সহজে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া মঞ্জুর না হয়, সেটাও দেখতে হবে।’
সহিংসতার চিত্র ভয়াবহ রূপ নেয় গত বছরের জুলাই ও আগস্টে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়। গত বছরের জুলাইয়ে এই আন্দোলনের সময় ৫০ জন শিশুর মৃত্যু নথিভুক্ত করেছে আসক। যাদের মধ্যে ৪৩ জনই ছিল ১৩-১৮ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী। আগস্ট মাসে এই সংখ্যা আরও বেড়ে ৭১ জনে দাঁড়ায়। যেখানে ৬০ জনই ছিল ১৩-১৮ বছর বয়সী। আসকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জুলাইয়ে ধর্ষণের শিকার হয় ৪২ জন নারী ও শিশু। যেখানে ৬ বছরের কম বয়সী ৪ জন শিশু এবং ১৩-১৮ বছর বয়সী ৯ জন কিশোরী রয়েছে। একই সময়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ১১ জন নারী।
আগস্ট মাসে ধর্ষণের সংখ্যা কমে এলেও শিশুদের ওপর যৌন সহিংসতার সংখ্যা ছিল নারীর কাছাকাছি। ধর্ষণের শিকার নারীদের মধ্যে বেশিরভাগই ১৩-১৮ বছর বয়সী। মোট ৯টি ধর্ষণের ঘটনায় দুজন মারা গেছে এবং ৫টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ৬ জনের মধ্যে মামলার সংখ্যা ৩। এ ছাড়া ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে দুটি ঘটনা, তবে কোনো মামলা হয়নি। ধর্ষণের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে ৬ জনের ওপর।
সেপ্টেম্বরে ১৪ জন নারী ধর্ষণের ঘটনার বিপরীতে ১৭ জন শিশুর ওপর যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ প্রতি নারী ধর্ষণের বিপরীতে প্রায় ১ দশমিক ২১ গুণ শিশু যৌন সহিংসতার শিকার হয়। অন্যদিকে হত্যার শিকার হয় ৪২ জন শিশু। অক্টোবরে ২৭টি নারী ধর্ষণের ঘটনার বিপরীতে ৩২টি শিশুর ওপর যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটে, যা প্রতি নারী ধর্ষণের বিপরীতে প্রায় ১ দশমিক ১৮ গুণ শিশু যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার চিত্র তুলে ধরে। একই সময়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় ৩ জন শিশুসহ ৮ জন।
নভেম্বর এই অনুপাত ছিল কাছাকাছি, যেখানে প্রতি নারী ধর্ষণের বিপরীতে সমপরিমাণ শিশু যৌন সহিংসতার শিকার হয়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে কিছুটা কমে গিয়ে প্রতি নারী ধর্ষণের বিপরীতে শূন্য দশমিক ৯৪ গুণ শিশু যৌন সহিংসতার শিকার হয়।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মোট ২১টি ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৮টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ। ধর্ষণের পর ৩৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে যেখানে ভুক্তভোগীর বয়স উল্লেখ নেই (৮টি ধর্ষণ, ১৩টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ)। ৬ বছরের কম বয়সী দুজন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা কিছুটা বেড়েছে, যেখানে মোট ৩০টি ধর্ষণ এবং ১৬টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৭ জনের এবং ৭-১২ বছর বয়সী শিশু ৬ জন। অন্যদিকে হত্যার শিকার হয় ৩৬ জন শিশু।
এই পরিসংখ্যানগুলো দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা এবং ধর্ষণের ভয়াবহতা তুলে ধরে, যা প্রতিরোধে আরও কার্যকর পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন সবচেয় ভয়াবহ আকার ধারণ করে চলতি বছরের মার্চ মাসে। মার্চে আসকের তথ্যমতে, ১৬০ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে ৮ জন শিশুসহ সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় ৩০ জন। একই সময়ে ১৮৮টি শিশু যৌন সহিংসতার শিকার হয়। এই মাসে প্রতি নারী ধর্ষণের বিপরীতে ১ দশমিক ৩৪ গুণ শিশু যৌন সহিংসতার শিকার হয়, যা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক।
এপ্রিল মাসে ৭৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে শিশুদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য (৬ বছরের নিচে ১৩ জন, ৭-১২ বছরের ১৩ জন)। এ ছাড়া ২০টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৮টির মামলা হয়। এপ্রিলে ধর্ষণের পর ৫ জন হত্যার শিকার হন।
অন্যদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, চলতি বছরের মে মাসে ৪৫ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হন। ৭ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। একই সময়ে আরও ১৪ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। এই সময়ে প্রতিটি নারী ধর্ষণের ঘটনার বিপরীতে প্রায় শূন্য দশমিক ৭৩ গুণ শিশু যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে।
যৌন সহিংসতার পাশাপাশি শিশু হত্যার ঘটনাও ছিল উদ্বেগজনক। গত বছরের জুলাইয়ে ৮৬টি শিশু হত্যার ঘটনা ঘটে। আগস্টে ৭১টি শিশু হত্যার ঘটনা ঘটে। এরপর সেপ্টেম্বরে ৪২ জন, অক্টোবরে ২৮ জন, নভেম্বরে ৪১ জন, ডিসেম্বরে ৫১ জন হত্যার শিকার হয়। এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৬ জন, মার্চে ৪১ জন এবং এপ্রিলে ৩৯ জন শিশু হত্যার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু যেসব নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা গণমাধ্যমে আসে, সেগুলোই নথিভুক্ত করে আসক। তবে অধিকাংশ নারী নির্যাতিত হয়েও লোকলজ্জার ভয়ে তা প্রকাশ করেন না। অনেকে সামাজিক সম্মানহানির ভয়েও মুখ খোলেন না। অধিকাংশ ঘটনা থানা পুলিশেও নথিভুক্ত হয় না। ফলে তা আমাদের অজানাই থেকে যায়। বাস্তবে এই পরিসংখ্যান আরও ভয়ংকর বলে মনে করছেন তারা।
সবচেয়ে মর্মান্তিক দিক হলো, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংসতায় নিহত শিশুদের ক্ষেত্রে কোনো মামলা হয়নি। এই বিচারহীনতা অপরাধীদের উৎসাহিত করতে পারে এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথে এক বিশাল বাধা সৃষ্টি করে। যখন অপরাধীরা জানে যে, তাদের কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে না, তখন তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে, যা সমাজে সহিংসতা আরও বাড়িয়ে তোলে।
আসকের সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর আবু আহমেদ ফাইজুল কবির বলেন, ‘বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা একটা স্থায়ী বাস্তবতা হয়ে গেছে। কিছু সময় তা দৃশ্যমান, কিছু সময় তা চাপা থাকে। কিন্তু মূল সমস্যা হলো, এটা থেমে নেই। সরকার পরিবর্তনের পর এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সে সময় থেকে আমরা লক্ষ করছি, একদল প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নারীর চলাফেরার স্বাধীনতা, পোশাক, সাংবিধানিক অধিকার—এসবকে তারা প্রকাশ্যেই বাধা দিচ্ছে।’ তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘ফুটবল খেলা বন্ধ করা, নারীর পোশাক নিয়ে বিতর্ক—এসব ঘটনা ইঙ্গিত দেয় নারীর অধিকার শুধু কাগজে থাকছে। বাস্তবতায় প্রতিক্রিয়াশীল চাপে নারীরা আবার সংকুচিত হচ্ছেন।’
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো সর্বত্র এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিবেশের জন্ম দিয়েছে। সমাজে বিরাজমান এই অস্থিরতা বিভিন্ন অপরাধ বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলছে।’
তিনি বলেন, ‘এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দৃশ্যমান ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। দুর্ভাগ্যবশত এই পদক্ষেপগুলো এখনো অনুপস্থিত। সরকারকে কঠোরভাবে উদ্যোগী হতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে।’
মন্তব্য করুন