চট্টগ্রামের পটিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে পুলিশ ও আন্দোলনকারীসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টা ও সাড়ে ১২টায় দুই দফায় পটিয়া থানার ভেতর ও থানার সামনে এ ঘটনা ঘটে।
সেদিন রাত সাড়ে ৯টায় রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি দীপঙ্কর দেকে ধরে থানায় সোপর্দ করতে যায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। কিন্তু তাকে থানা-পুলিশ গ্রেপ্তার না করার কথা জানালে এ নিয়ে আন্দোলনকারী নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের উত্তেজনা দেখা দেয় এবং এক পর্যায়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
ওই ঘটনার পরপরই ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। গতকাল বুধবার সকাল ১০টায় ‘পটিয়া ব্লকেড’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন এনসিপির জাতীয় যুবশক্তির যুগ্ম সদস্য সচিব নীলা আফরোজ। পাশাপাশি বিকেল ৩টায় চট্টগ্রাম নগরীর ২ নম্বর গেট এলাকার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে ‘চট্টগ্রাম ব্লকেড’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন তিনি। এদিন সকাল পৌনে ১১টায় পটিয়া থানার সামনে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের একটি অংশ। আন্দোলনকারীরা জানান, পুলিশি লাঠিচার্জে তারা ক্ষুব্ধ ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জাহেদ মো. নাজমুন নূরের অপসারণ দাবি করেন।
দুপুর সাড়ে ১২টায় সরেজমিন দেখা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা থানার সামনে অবস্থান নেন। তারা পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিলেন। বাইপাস সড়কে পটিয়া মডেল মসজিদের সামনে মহাসড়কে অবস্থান করছিলেন নেতাকর্মীরা। সেখানে আন্দোলনকারীরা টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। অবরোধে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক কার্যত অচল হয়ে পড়ে। তবে পরীক্ষার্থী ও অ্যাম্বুলেন্স চলাচল করতে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। এ ছাড়া নেতাকর্মীদের একটি অংশ মহাসড়ক অবরোধ করেন। বিক্ষোভে যোগ দেন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক খান তালাত মাহমুদ রাফিও। অবস্থান কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা ‘ওসি তুই স্বৈরাচার—এ মুহূর্তে পটিয়া ছাড়, দালালি না রাজপথ—রাজপথ রাজপথ, ইনকিলাব ইনকিলাব—এমন বিভিন্ন স্লোগান দেন। অবরোধের কারণে ভোগান্তিতে পড়েন পথচারী ও যাত্রীরা। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম নগরের মুখ্য সংগঠক তাওসিফ ইমরোজ বলেন, আগামী ১২ ঘণ্টার মধ্যে পটিয়া থানার ওসি আবু জায়েদ নাজমুন নুরকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। পটিয়া থানার সেকেন্ড অফিসার আসাদ নুরকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার ও চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম শান্তনুকে তার দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। পুলিশ সংস্কার নিয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান জানাতে হবে। এ সময়ের মধ্যে প্রশাসন থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা না ফেলে পরে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
বেলা ৩টায় ঘটনাস্থলে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্লাবন কুমার বিশ্বাস, পটিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানুর রহমান, সেনাবাহিনী ও র্যাব আসে। তারা আন্দোলনকারীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। তবে আন্দোলনকারীরা জানান, ওসির অপসারণ আদেশ এলে তারপর তারা সরবেন। সন্ধ্যা ৭টায় চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি আহসান হাবীব পলাশের সঙ্গে কথা বলে সড়ক ছাড়েন আন্দোলনকারীরা। পরে রাত ৮টা ৪০ মিনিটে নীলা আফরোজ ফেসবুকে এক পোস্ট দিয়ে জানান, পটিয়া থানার ওসিকে অপসারণের বিষয়ে আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত সময় চেয়েছেন রেঞ্জ ডিআইজি। পরে গতকাল রাত সাড়ে ১০টায় পটিয়া থানার ওসি আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূরকে প্রত্যাহার করা হয়। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম রাতে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, পটিয়ার ওসিকে প্রত্যাহার করে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।
এর আগে গতকাল দুপুর আড়াইটা থেকে নগরীর খুলশীতে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি অফিস ঘেরাও ও সড়ক অবরোধ করেন এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের একাংশ। এতে নগরীর ব্যস্ততম জিইসি-একে খান সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দেড় ঘণ্টা পর সড়কের একপাশ ছাড়েন তারা। এতে এক পথে চলছে যানবাহন। তবে রাত ৭টা পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে যানজট দেখা গেছে। চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা যেন বিঘ্নিত না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এদিকে পুলিশ সূত্র জানায়, ওই ছাত্রলীগ কর্মীর নাম দীপঙ্কর দে (২৯)। তিনি রাঙামাটি জেলার বনরূপা বাজার এলাকার মৃত গৌরাঙ্গ দের ছেলে। তবে তাদের পৈতৃক নিবাস পটিয়ার সুচক্রদণ্ডি ২ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায়। গতকাল বেলা ৩টায় তাকে ৫৪ ধারায় (সন্দেহজনক হিসেবে) আদালতে পাঠানো হয়েছে।
পটিয়া থানার ওসি আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূর বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা ছাত্রলীগের এক নেতাকে থানায় এনে মব সৃষ্টি করে মারধর করা শুরু করে। তাদের মধ্য থেকে একদল থানার দেয়াল অতিক্রম করে মব নিয়ে ঢুকে যাচ্ছিল। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। এতে তিন-চারজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।’
তবে আহত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা রিদোয়ান সিদ্দিকী কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে খবর আসে রাঙামাটি ছাত্রলীগ নেতা পটিয়া স্টেশনে আছে। পরে আমি পটিয়ায় ঘটনাস্থলে যাই। তাকে ধরে থানায় নিয়ে গেলে আমিসহ আমাদের কর্মীদের ওপর পুলিশ লাঠিপেটা করে। এতে আহত কয়েকজনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আমাকে প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে পার্কভিউ, পরে ন্যাশনাল হসপিটালে আমাকে ভর্তি করা হয়। বেশিরভাগের অবস্থা গুরুতর।’
মন্তব্য করুন