জাফর ইকবাল
প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২৫, ০৮:১৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দুদককে থামিয়ে দিতে বিশেষ সহকারীর চিঠি

দেড়শ কোটির প্রকল্পে ব্যয় ৩২৬ কোটি
বিশেষ সহকারী
ছবি : কালবেলা গ্রাফিক্স

চাহিদা মাত্র ২৬ টেরাবাইট ব্যান্ডউইথের, অথচ কেনা হচ্ছে ১২৬ টেরাবাইট সক্ষমতার যন্ত্রপাতি, তাও প্রায় ৩২৬ কোটি টাকায়। যেখানে প্রকৃত প্রয়োজন মেটাতে সর্বোচ্চ ১৬৫ কোটি টাকা যথেষ্ট। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সুপারিশ, এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্পষ্ট আপত্তিও উপেক্ষা করে অপ্রয়োজনীয় এই যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নিচ্ছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। তথ্য বলছে, এই প্রক্রিয়া সচল রাখতে দুদকের কার্যক্রমে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। যিনি নিজ প্যাডে চিঠি দিয়ে প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন। পরীক্ষায় যথাযথ ফল না পাওয়া এসব যন্ত্রপাতির কার্যকারিতা ৬-৮ বছর এবং শেষতক ভাঙাড়ি হিসেবে বিক্রির শঙ্কা থাকলেও টাকার স্রোত থামাতে নারাজ সংশ্লিষ্টরা। তদন্তের তথ্য-উপাত্ত বলছে, সরকারের শতকোটি টাকা গচ্চার শঙ্কা রয়েছে। প্রযুক্তির আড়ালে চলছে গোপন লুটপাটের আয়োজন। দুদক চেয়ারম্যানকে কোম্পানির সাফাই গেয়ে বিশেষ সহকারীর চিঠি দেওয়াকে দুদকের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, পতিত হাসিনা সরকারের আমলে লুটপাটের উদ্দেশ্যে নেওয়া একটি বিতর্কিত ও উচ্চাভিলাষী প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রভাবশালী মহলের এসব তদবির এবং চেষ্টা নিঃসন্দেহে পরিবর্তিত বাংলাদেশে খারাপ নজির হয়ে থাকবে।

তবে দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব কালবেলাকে বলেছেন, তার এই পদক্ষেপে সরকারের ৬০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া দেশের দুটি প্রভাবশালী কোম্পানি চাচ্ছে না যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ট্রান্সমিশন ব্যবসায় থাকুক। তারা সরকারি কোম্পানিকে ভবিষ্যতের সক্ষমতা বিস্তৃতি থেকে সরিয়ে দিতে চায়।

সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের মোট চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ পূরণ করে দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বাকি ৩০ শতাংশ সরবরাহ করে বিটিসিএল। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে তিনটি কোম্পানি দেশের ইন্টারনেট চাহিদা পূরণ করে। কোম্পানিগুলো সারা দেশে ব্রডব্যান্ড লাইনের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেয়। প্রতিটি মোবাইল ফোন অপারেটর ব্যান্ডউইথের বড় ক্রেতা। এসব কোম্পানি পাইকারি কিনে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে খুচরা ইন্টারনেট বিক্রি করে। বর্তমানে বিটিসিএল চাহিদা পূরণে ব্যান্ডউইথ ধারণের জন্য মাত্র ৭ টেরাবাইট সক্ষমতার অবকাঠামো ব্যবহার করে। বিটিসিএলের সক্ষমতা বাড়াতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ‘ফাইভজি উপযোগীকরণে বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয়। বুয়েটের মাধ্যমে প্রকল্পের ফিজিবিলিটি পরীক্ষা করা হয়। এতে খরচ হয় প্রায় ২৮ লাখ টাকা। বুয়েটের ফিজিবিলিটি স্টাডি প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী দল দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলার বিদ্যমান ব্যান্ডউইথ ব্যবহার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা ব্যান্ডইউথ ইত্যাদি বিবেচনা করে একটি সূত্রের মাধ্যমে ২০৩০ সালে বিটিসিএলের ব্যান্ডউইথ চাহিদা ২৬ দশমিক ২ টেরাবাইট নির্ধারণ করে। এই ব্যান্ডউইথ সরবরাহের জন্য বুয়েট ১০০জি লাইন কার্ড স্থাপনের সুপারিশ করে। বুয়েট এ সমীক্ষাটি চালায় করোনাকালীন। সে সময়ে দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার সর্বোচ্চ ছিল।

তবে বুয়েটের প্রতিবেদন উপেক্ষা করে সুকৌশলে ২৬ টেরাবাইটের পরিবর্তে ১২৬ টেরাবাইটের যন্ত্রপাতি কেনার ফন্দি আঁটেন তৎকালীন হাসিনা সরকারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। ২৬ টিবিপিএসে সর্বোচ্চ ১৫ মিলিয়ন ডলার (দরপত্র আহ্বানের সময় প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকা হিসাবে ১৬৫ কোটি টাকা) খরচে যে কাজ করা সম্ভব ছিল, সেটা করতে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৩২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে যন্ত্রপাতি কেনার সব আয়োজন চূড়ান্ত করে। অবশ্য ডলারের বর্তমান বিনিময় হার ধরলে টাকার অঙ্ক আরও বেশি।

যা বলছে বুয়েটের সমীক্ষা: বুয়েটের সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে জেলার মধ্যে ব্যান্ডউইথ চাহিদার ঐতিহাসিক তথ্য না থাকায় বুয়েট টিম একটি নতুন সূত্র তৈরি করেছে ২০৩০ সালের জন্য। এই সূত্রে প্রতিটি উপজেলায় জনসংখ্যা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ইপিজেড, সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যাংক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ব্যান্ডউইথের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, ঢাকা জেলার বর্তমান ব্যবহৃত ব্যান্ডউইথের পরিমাণ ৪০০ জিবিপিএস। বুয়েটের পরামর্শে এখানে আরও ৩৮০০ জিবিপিএস বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তাহলে সর্বমোট জিবিপিএস বেড়ে দাঁড়াবে ৪২০০। একইভাবে বরগুনায় চলমান ১২ জিবিপিএসের সঙ্গে ২০০ জিবিপিএস অতিরিক্ত, বরিশালে ৬০-এর সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ৪০০, ভোলায় ১৩ জিবিপিএসের সঙ্গে আরও ৩০০ জিবিপিএস, চট্টগ্রামে ১৪০ জিবিপিএসের সঙ্গে আরও ১২০০ জিবিপিএস অতিরিক্তি, কক্সবাজারে ৪১ জিবিপিএসের সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ৫০০, গাজীপুরে ১১০ জিবিপিএসের সঙ্গে আরও ৫০০ জিবিপিএস অতিরিক্ত, মাদারীপুরে ১১ জিবিপিএসের সঙ্গে আরও অতিরিক্ত ৩০০ জিবিপিএস, খুলনায় ৭০ জিবিপিএসের সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ৫০০, ময়মনসিংহে ৪৫ জিবিপিএসের সঙ্গে আরও অতিরিক্ত ৮০০ জিবিপিএস এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১১ জিবিপিএসের সঙ্গে আরও অতিরিক্ত ৩০০ জিবিপিএস যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে বুয়েট।

জানা গেছে, ১০২৪ জিবিপিএসে ১ টেরাবাইট। আর বুয়েট ঢাকা বিভাগের জন্য সর্বোচ্চ সুপারিশ করেছে ৩৮০০ জিবিপিএস বা ৩ দশমিক ৭১ টিবিপিএস। সব মিলিয়ে ৬৪ জেলায় ২০৩০ সালে সর্বোচ্চ ব্যান্ডউইথ লাগতে পারে ২৬ দশমিক ২ টেরাবাইট।

জানা গেছে, যে কেবলের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করা হবে, সেই কেবল সাধারণত ৩ ধরনের। এগুলো হলো ১০জি, ১০০জি ও ৪০০জি। বুয়েট এ ক্ষেত্রে ঢাকা থেকে জেলা শহরের জন্য সুপারিশ করেছে ১০০জি লাইন। আর জেলা শহর থেকে উপজেলায় প্রস্তাব করা হয়েছে ১০জি লাইন। ১০০জি লাইন দিয়ে ১০০ টেরাবাইট ডাটা/ব্যান্ডউইথ স্থানান্তর হতে পারে। আর এসব লাইন অ্যাসন (Ason) বেজড করার কথা বলা হয়েছে। অ্যাসন লাইনের বিশেষত্ব হলো, কোনো একটি জেলা শহরে কেবল কাটা পড়লেও অন্য লাইন দিয়ে ব্যান্ডউইথ ওই জেলা শহরে পৌঁছে যাবে। ঢাকা জেলায় বর্তমানে ব্যবহারিত হচ্ছে ৪০০ জিবিপিএস। এর সঙ্গে প্রস্তাবিত ৩৮০০ জিবিপিএস যুক্ত হলে মোট ব্যান্ডউইথের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪২০০ জিবিপিএস বা ৪ দশমিক ১০ টেরাবাইট। আর সারা দেশে এর পরিমাণ হতে পারে সর্বোচ্চ ২৬ দশমিক ২ টেরাবাইট। বুয়েটের সুপারিশ করা ১০০জি কেবল দিয়ে ১০০ টিবিপিএস বা তার চেয়েও বেশি ডাটা/ব্যান্ডউইথ চলাচল করতে পারবে। অর্থাৎ প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি প্রস্তাব করেছে বুয়েট। তবুও বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে ৪০০জি লাইন স্থাপনের সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে মন্ত্রণালয়। এতে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণে অর্থ অপচয় হবে। যা বিদেশে চলে যাবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই প্রকল্প নিয়ে সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বাব এবং সাবেক সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। তারা দুজনেই তাদের পছন্দের আলাদা আলাদা ঠিকাদারকে কাজ দিতে চাইছিলেন। তবে অন্যায় আদেশ না মেনে দরপত্র বাতিল করেছিলেন বিটিসিএলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী। যার জেরে তাকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। প্রথমে স্ট্যান্ডরিলিজ ও পরে সাময়িক বরখাস্ত এবং একাধিক বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। যদিও আদালতের আদেশে সেই মামলা স্থগিত রয়েছে। এরপর সাবেক আরেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের সঙ্গে সচিবের সখ্যতায় সব নিয়মকানুন উপেক্ষা করে চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ে টেকনোলজিস লিমিটেডকে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। অন্যদিকে বিটিসিএল এমডি আসাদুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে দায়ের করা সব বিভাগীয় মামলা আদালতের রায়ে স্থগিত হলে ওই অসাধু সিন্ডিকেট অভিযোগ দেয় দুর্নীতি দমন কমিশনে। দুদকে জমা দেওয়া অভিযোগে প্রকল্প পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পিপিএ-২০০৬-এর ধারা ৮ এবং পিপিআর-২০০৮ এর বিধি (১১), (৮৪) এর (গ) (৫) অনুসরণ না করে বাতিলপূর্বক ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে অপরাধ করার অভিযোগ আনা হয়।

তবে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। দুর্নীতি দমন কমিশন দেখতে পায় ঘটনা ঠিক উল্টো। এরপর দুদক প্রকাশ্য অনুসন্ধান শুরু করলে বন্ধ হয়ে যায় সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া।

অনুসন্ধানে দুদক পদে পদে অনিয়মের প্রমাণ পায়। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি গোপনীয়তার শর্ত লঙ্ঘন, অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করে সরকারি বিপুল অর্থের অপচয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, পিপিআর লঙ্ঘন, বুয়েটের প্রস্তাবের চেয়ে চার গুণ বেশি যন্ত্রাংশ ক্রয় চেষ্টার সত্যতা পায়। অভিযোগটি এখনো দুর্নীতি দমন কমিশনে অনুসন্ধানাধীন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ সরবরাহ যন্ত্রপাতি ৬ থেকে ৮ বছর কার্যকর থাকে। এরপর এসব যন্ত্রপাতি কোনো কাজে লাগে না। চিপসসেট পরিবর্তন হয়। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে আসে আরও উন্নত যন্ত্রাংশ। এসব বিষয় মাথায় রেখেই প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা করতে হয়। বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি অপারেটর মিলিয়ে যে পরিমাণ ব্যান্ডউইথ বহন করছে, তাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ ২৬ দশমিক ২ টেরাবাইট সামর্থ্যের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হবে। বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলও তাই প্রস্তাব করেছে। অথচ ২৬ টেরাবাইটের পরিবর্তে ১২৬ টেরাবাইটের যন্ত্রপাতি কেনা হলে বাড়তি যন্ত্রাংশ কোনো কাজেই আসবে না। ৬ থেকে ৮ বছর পর এসব যন্ত্রাংশ অকেজো হয়ে পড়ে থাকবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্ষমতার পটপরিবর্তনে পুরোনো সিন্ডিকেট আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রকল্পের সরঞ্জাম আমদানি করতে জোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওই সিন্ডিকেটের প্রধান বাধা দুর্নীতি দমন কমিশন। তাই প্রথম গত ১৩ এপ্রিল ডাক, টেলি যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে দুদকে চিঠি দিয়ে প্রকল্পের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। গত ১৮ জুন মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাব দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন। দুদকের তৎকালীন সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে স্পষ্ট করে বলা হয়, ‘এ প্রকল্পের ক্রয় প্রক্রিয়ার অবশিষ্ট কার্যক্রম এগিয়ে/চালিয়ে নিলে তা আইনের ব্যত্যয় হবে বলে প্রতীয়মান হয় এবং সংশ্লিষ্ট অর্থ ব্যয় আইনসিদ্ধ হবে না বলে অনুমেয়।’ দুদকের এই মতামত পাওয়ার পর ২২ জুন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব তার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্যাডে একটি আধা সরকারি পত্র দেন দুদক চেয়ারম্যানকে। তাতে এই প্রকল্পের সুফল ও গুরুত্ব তুলে ধরে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘দেশের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় ফাইভ-জির রেডিনেস পিছিয়ে পড়া রোধ, প্রযুক্তিগতভাবে বিটিসিএলের পিছিয়ে পড়া রোধ, এডিপি বাস্তবায়নের হার নিশ্চিত করাসহ নানা কারণে এই প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রাখা একান্ত প্রয়োজন।’ এ ক্ষেত্রে তিনি বুয়েটের ২৬ টেরাবাইট প্রয়োজনীয়তার প্রতিবেদন উপেক্ষা করে নিজের মতো যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছেন, হুয়াইয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি এবং এসব ইকুইপমেন্টস বর্তমানে বাংলাদেশের বেসরকারি ট্রান্সমিশন কোম্পানিগুলো ব্যবহার করছে। বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত এসব পণ্য বিটিসিএলের উচ্চ ক্ষমতার ট্রান্সমিশনে এলে একদিকে যেমন সরকারের বাড়তি সুফল, অন্যদিকে এ খাতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য হ্রাস পাবে। প্রকল্পটির বিরুদ্ধে দরকারের তুলনায় পাঁ চগুণ বেশি ক্যাপাসিটির যে অভিযোগ এসেছে, বাস্তবে তা সত্য নয়। বরং দেশের বর্তমান ইন্টারনেট ফুটপ্রিন্ট প্রায় ৩৫ টেরাবাইটের কাছাকাছি এবং ইন্টারনেট ক্যাপাসিটির চাহিদা বৃদ্ধির বার্ষিক হার প্রায় ৫০ শতাংশ। এমতাবস্থায় আগামী এক যুগের চাহিদার আলোকে ১২৬ টেরাবাইটের ক্যাপাসিটি মোটেই বেশি নয়, বরং ২৬ টেরাবাইটের হিসাব ভুল এবং অপরিণামদর্শী। তদুপরি প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অধিক ক্যাপাসিটির নিশ্চয়তা জনস্বার্থে কল্যাণকর। এমতাবস্থায় দেশের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনা, ৫জির রেডিনেস পিছিয়ে পড়া রোধ, প্রযুক্তিগতভাবে বিটিসিএল পিছিয়ে পড়া রোধ, এডিপি বাস্তবায়নের হার নিশ্চিত করা এবং এ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিটিসিএলের অপর একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এরই মধ্যে স্থাপিত যন্ত্রপাতি চালুর লক্ষ্যে বিটিসিএলের ‘৫জির উপযোগীকরণে বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রাখা একান্ত প্রয়োজন। এরপর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত মনোযোগ ও আন্তরিক সহযোগিতা চান। গত এক সপ্তাহ ধরে মন্ত্রণালয় ও দুদকের একাধিক সূত্র থেকে এসব চিঠিপত্রের সত্যতা নিশ্চিত করেছে কালবেলা।

জানতে চাইলে হুয়াওয়ের পাবলিক অ্যাফেয়ার্স এবং কমিউনিকেশন বিভাগের সাউথ এশিয়ার এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন প্রধান তানভীর আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘এ প্রকল্পটি পাওয়ার পর থেকেই আমাদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। আমরা এ কাজটা করতে চাই। আমরা তো বৈধভাবেই সব নিয়ম-কানুন মেনেই কাজটা পেয়েছি।’

পিপিআরের গোপনীয়তার শর্ত লঙ্ঘনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি আরও অনেক আগের ঘটনা। পরবর্তী সময়ে সিপিপিটিইউর মাধ্যমে এ বিষয়ে সমাধান হয়েছে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘সম্প্রতি দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন হুট করে একটা চিঠি দিয়ে বলেছেন, যে প্রকল্পে দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। এটা উনি কিসের ভিত্তিতে বললেন?’ দুদক সচিব হুট করে নয় বরং মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাব দিয়েছেন উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘তাহলে উনি ওএসডি হলেন কেন?’

খোরশেদা ইয়াসমীন অবসরে যাবেন তাই তাকে দুদক থেকে সরিয়ে জনপ্রশাসনে সংযুক্ত করা হয়েছে জানালে তানভীর আহমেদ বলেন, ‘যাই হোক, উনি তো এটা (চিঠি) দিতে পারেন না।’ এরপর তানভীর আহমেদ হুয়াওয়ে এবং এ প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত জানান।

জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব (রুটিন দায়িত্ব) মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে এখন কিছুই বলতে পারব না। আর আমি এ বিষয়ে কিছু জানিও না।’

যা বলছে দুদক: দুদকের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘এ প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা ক্রিমিনাল অফেন্স। আর ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে কোনো সুপারিশের সুযোগ নেই। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দুর্নীতি দমন কমিশন মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাব দেওয়ার পরও বিশেষ সহকারী তার নিজ প্যাডে আধাসরকারি পত্র পাঠিয়ে মূলত দুদককেই একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি দিলেন। এ ধরনের কার্যক্রম দুদকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের শামিল।’

জানতে চাইলে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মইদুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কেউই দুদকে এ ধরনের চিঠি দিতে পারেন না। এ ধরনের চিঠি দেওয়া উচিত নয়। এতে দুদক বিব্রত হয়। দুদকের নিজস্ব আইন ও বিধিবিধান রয়েছে। দুদক সেগুলো অনুযায়ী কাজ করে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি করলে দুদক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এটাই হওয়া উচিত। এ ধরনের চিঠিতে অনেক সময় অ্যামব্যারাসিং পরিস্থিতি তৈরি হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুদক তো প্রকল্প চালিয়ে নিতে বলতে পারে না। আর প্রকল্প চালিয়েই বা নেবে কীভাবে, সেই প্রকল্পের অনুমোদনই যদি আইনসংগত না হয়?’

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের ব্যাখ্যা: জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব কালবেলাকে বলেন, ‘আমি আমাদের দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চিঠি দিয়েছি। এটা নিয়ে কথা বলতে আমি দুদকেও গিয়েছি। দুদকে আমি আমার টিম নিয়ে গিয়েছি। এটার ব্যাকগ্রাউন্ডটা হচ্ছে এ প্রকল্পটা অনেক আগে থেকে হচ্ছে। যে ইক্যুইপমেন্ট কেনার কথা, সেই ইক্যুইপমেন্ট বাংলাদেশে সামিট এবং ফাইভার এট হোমের আছে। তবে অভিযোগ আছে, চায়নিজ দুটি ভেন্ডর জেডটিই এবং হুয়াওয়ে নিজেদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারে এখানে আনফেয়ারনেস (অসামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ) করেছে। এটা আমি অনেক আগে একটা লেটার (চিঠি) দিয়েছি। সেই লেটারের মধ্যে বিস্তারিত বলেছি।’

চিঠি দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘চিঠিটা আমি এ কারণে দিয়েছি যে, প্রথমত প্রকল্পটা যদি না করে, তাহলে আমাদের ২৯০ কোটি টাকার যে ই-রিভার্সেবল এলসি; যে টাকাটা পেমেন্ট হয়ে গেছে। এটা আমরা দায়িত্বে আসার আগে, আমি এবং নাহিদ ইসলাম দায়িত্বে আসার আগেই সেই টাকা পেমেন্ট হয়ে গেছে। সেটা মার যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের দুটা প্রভাবশালী কোম্পানি চাচ্ছে না বিটিসিএল ট্রান্সমিশন ব্যবসায় থাকুক। তারা সরকারি কোম্পানিকে ভবিষ্যতের ক্যাপাসিটি এক্সপানশন (সক্ষমতার বিস্তৃতি) থেকে সরিয়ে দিতে চায়। এখন যে ইক্যুইপমেন্ট দিচ্ছে সেই ইক্যুইপমেন্টে কোনো সমস্যা নেই। এটা বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত। তাই আমি দুদক চেয়ারম্যানকে লিখেছি, যেহেতু আমার টাকা চলে গেছে এবং এখন আমি যদি রি-টেন্ডার করি তাহলে ২৯০ কোটি টাকা চলে যাচ্ছে, এ ছাড়া একই দিকে ৬০০ কোটি টাকার বেশি লাগবে ন্যূনতম। তাহলে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের ৯০০ কোটি টাকা চলে যাচ্ছে। সে জন্য আমি দুদক চেয়ারম্যানকে বলেছি, স্যার আপনি আমাকে এ কাজটা করতে দেন। উনি বলেছেন, “আপনি এনশিওর করবেন রাইট ইক্যুইপমেন্ট দেশে আসছে”। সেজন্য আমি বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলেছি, আপনারা এ খাতের যারা বিশেষজ্ঞ তাদের দিয়ে একটা কমিটি করেন। যাতে যেই প্রমিস ইক্যুইপমেন্টটা (দরপত্র অনুযায়ী যা দেওয়ার কথা) আছে সেই প্রমিস ইক্যুইপমেন্টটা দেশে আসে।’

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব আরও বলেন, ‘আমি অর্থ ছাড় করিনি। আমি এবং নাহিদ ইসলাম দায়িত্ব নেওয়ার অনেক আগেই রাষ্ট্রের অর্থ গচ্চা গেছে। এখন দুদক যদি মনে করে এ টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম হয়েছে, দুদক অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে শাস্তি দিতে পারে। আর একটা কথা আছে— আমরা সন্দেহ করি কিছু লোক, বেসরকারি যে মাফিয়ারা আছে, তারা প্রভাবিত হয়ে এ কাজটা বন্ধ করে দিতে চায়। কারণ এখানে দুটা বিশেষ কোম্পানি চায় না যে বিটিসিএল ট্রান্সমিশন ব্যবসায় থাকুক।’

যা বলছে টিআইবি: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘প্রশ্ন হচ্ছে প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার যৌক্তিকতা নির্ধারণে যথাযথভাবে কস্ট-বেনিফিট ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ করা হয়েছে কি না। বিশেষ করে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ নির্ভর পর্যালোচনা যদি না হয়ে থাকে, তবে তা হবে প্রকারান্তরে দুর্নীতি সহায়ক ও সুরক্ষামূলক। হুয়াওয়ে নিঃসন্দেহে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিশাল গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি, তবে একই সঙ্গে এ কোম্পানি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। এলসির অর্থ লোকসানের যুক্তিতে প্রকল্প এগিয়ে নিলে রাষ্ট্রের আরও বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তের কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া বা তদন্ত প্রক্রিয়া প্রভাবিত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সিদ্ধান্ত যা-ই হোক, কোনো প্রকারেই তা যেন দুর্নীতির তদন্তকে প্রভাবিত না করে এবং তদন্তাধীন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পে সংশ্লিষ্টতার সহায়ক না হয়।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে যুবক নিহত

এজবাস্টনে ভারতের ঐতিহাসিক জয়

গাজীপুর মহানগর বিএনপির চার নেতা বহিষ্কার

সাইফ পাওয়ার টেকের অধ্যায় শেষ, চট্টগ্রাম বন্দরের দায়িত্বে নৌবাহিনী

এসিল্যান্ডসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা

পুকুরের পানিতে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু

অভিষেকেই ইতিহাস, ডাবল সেঞ্চুরিতে প্রোটিয়া অলরাউন্ডারের বিশ্বরেকর্ড

৪৫ বছরে পদার্পণ করল লোক নাট্যদল

চিলমারীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, পুলিশের টহল জোরদার

সবার প্রতি মির্জা ফখরুলের আহ্বান

১০

‘ডিসি-এসপিরা চিপায় পড়ে’ আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছেন : হাসনাত

১১

অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দেখতে মাঠে ঢুকে পড়ল কুকুর

১২

সংস্কার কমিশনের আগে সংস্কার জরুরি : খেলাফত আন্দোলনের আমির

১৩

জুলাই শহীদদের স্মরণে ২ হাজার এতিমের জন্য খাবারের আয়োজন

১৪

জোতার শেষকৃত্যে না গিয়ে পার্টিতে, সমালোচনার মুখে লিভারপুল তারকা

১৫

সাংবাদিকদের নয়, বসুন্ধরা মিডিয়াকে হুমকি দিয়েছি : হাসনাত

১৬

দিল্লি থেকে শেখ হাসিনার লন্ডনে যাওয়ার খবর নিয়ে যা জানা গেল

১৭

কারও উদ্যোগে ইন্টারনেট বন্ধ হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা : আইসিটি সচিব

১৮

কানাডা ছেড়ে চলে যাচ্ছে মানুষ, কী হলো?

১৯

চোখের নিচে কালো দাগ দূর হবে ৩ সবজিতে

২০
X