ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে যোগ দেন গত সোমবার। এতে গতি ফেরে সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রমে। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজে ফেরার পর আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানো হয়েছে, সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে কয়েকজনকে। পাশাপাশি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব কারণে কাজে ফিরলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। সামনে এ ধরনের পদক্ষেপ আর না নেওয়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে বলে ব্যবসায়ী নেতারা জানালেও শঙ্কা কাটছে না এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। বিষয়টি স্বীকার করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খানও। একই সঙ্গে সবাই নিজের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করলে ভয়ের কোনো কারণ নেই বলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভয় দিয়েছেন তিনি।
এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্দোলন প্রত্যাহারের পর থেকে সবার মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করছে। কর্মকর্তাদের মধ্যে আস্থা-অনাস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের চিন্তায় ঠিকমতো কাজে মনোনিবেশ করতে পারছেন না অনেকে। বিষয়টি জোরালো হয়েছে আয়কর ও শুল্ক বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানোর পর। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, এনবিআরের সব কর্মকর্তা এক ধরনের না—এটা যেমন সত্য, তেমনি শুল্ক ক্যাডারে যে তিনজন কর্মকর্তা শাস্তি পেয়েছেন, তারা অনেকের তুলনায় কর্মদক্ষ এবং সজ্জন হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া আয়কর বিভাগের এক কমিশনারের বাধ্যতামূলক অবসর নিয়েও রয়েছে অনেকের আক্ষেপ।
একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে জানান, কোনো ধরনের অন্যায়-অনিয়ম না করে শুধু আন্দোলন করার কারণে দুদকের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো নিজের এবং পরিবারের জন্য খুবই অসম্মানজনক। তবে যারা এখনো অনিয়ম করে যাচ্ছেন, তাদের কিছু হচ্ছে না। তারা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়িত আছেন এবং থাকবেন। তারাই আবার গণক্ষমা চাইতে আন্দোলনে থাকা অনেককে অলিখিত চাপ দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন কর্মকর্তারা। তারা জানান, আয়কর ক্যাডারের কর্মকর্তারা শাস্তি থেকে রেহাই পেতে গতকাল সোমবার গ্রুপ ধরে ক্ষমা চাইতে এনবিআরের কয়েকজন সদস্যের রুমের সামনে জড়ো হন। পরের ধাপে আজ মঙ্গলবার ব্যাচ ধরে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় শুল্ক বিভাগের কিছু কিছু কর্মকর্তাও শাস্তি এড়াতে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে গণক্ষমা চাইতে পারেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
এ ছাড়া আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে ১১ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। আরও শতাধিক কর্মকর্তার তালিকা প্রস্তুত বলেও গুঞ্জন রয়েছে এনবিআরে। এই পরিস্থিতিতে কর্মপরিবেশ নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন এনবিআরের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। যদিও একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা কালবেলাকে জানিয়েছেন, আন্দোলনের কারণে যাতে আর কোনো কর্মকর্তা হয়রানি বা শাস্তির মুখোমুখি না হন, সেই বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়া হবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বিসিআইর সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) কালবেলাকে বলেন, ‘এনবিআরের এই পরিস্থিতিতে কর্মকর্তাদের উদ্বিগ্ন হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে আমরা আজ (সোমবার) সরকারের সঙ্গে এনবিআরের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, আর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।’
এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্বেগের বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খানও। গতকাল সোমবার ঢাকা কাস্টম হাউসের একটি অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আস্থার সংকট কাটাতে কর্মকর্তাদের কাছে চলে এলাম। তাদের অভয় দেওয়ার জন্য। প্রত্যেকে যদি দায়িত্বশীল আচরণ করেন, তাদের যে কাজকর্ম সেগুলো যদি তারা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন, তাহলে আমি মনে করি না তাদের ভয়ের কোনো কারণ আছে। কেউ কেউ বড় আকারের সীমা লঙ্ঘন করেছেন, সেটা হয়তো ভিন্নভাবে দেখা হবে। তবে সাধারণভাবে আমার মনে হয় না কারও ভয়ের কোনো কারণ আছে।’ এনবিআরে এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে রাজস্ব আহরণে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে কি না—জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘এটা তো চলতে থাকবে না। রাজস্ব বিভাগে যারা কর্মরত আছেন তারাই রাজস্ব আদায় করবেন। এটা তাদের কাজ। এত ঝামেলার মধ্যেও তারা রাজস্ব আদায় করেছেন। আপনারা যে ভয় পাচ্ছেন রাজস্ব আদায় হবে না, আতঙ্ক কাজ করছে—এগুলো কেটে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এদিকে, আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে ফেরা এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টার্গেট করে দুদকের অনুসন্ধান চালানো গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি কালবেলাকে বলেন, সর্বপ্রথম বিষয় হলো, এনবিআর সংস্কার নিয়ে কারও আপত্তি নেই। আপত্তি ছিল এনবিআরে আমলাতন্ত্রের (বিসিএস প্রশাসন) পদায়ন এবং সরকার গঠিত কমিটির প্রতিবেদন পাশ কাটিয়ে একটি সিদ্ধান্ত এনবিআর কর্মীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে। তাদের এই প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠে আন্দোলন। তবে এনবিআর কর্মীদের এই আন্দোলনের প্রক্রিয়া যেমন ঠিক হয়নি, তেমনি আন্দোলনে থাকার কারণে দুদকের তদন্তও অগ্রহণযোগ্য। এনবিআরের অনেক কর্মীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, যদিও শুধু আন্দোলনকে টার্গেট করে দুদককে ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমান যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা এড়াতে দ্রুত সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
মন্তব্য করুন