বিভিন্ন ইস্যু ঘিরে সম্প্রতি বিএনপিকে ‘চাপে ফেলার প্রবণতা’ চলছে বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। তারা বলছেন, কোনো নেতিবাচক ঘটনা ঘটলেই সংঘবদ্ধভাবে বিএনপির নেতাকর্মীদের জড়িয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও নেট দুনিয়ায় কটাক্ষপূর্ণ এবং অশালীনভাবে আক্রমণ চলছে। অথচ যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিএনপি সবসময় ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ গ্রহণ করেছে। দলের উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীদের লাগাম টানতে বহিষ্কারের মতো কঠোর অবস্থানে দলের হাইকমান্ড।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ধৈর্যের সঙ্গে এগোচ্ছে বিএনপি। এক্ষেত্রে বেশি ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের বক্তব্য, কর্মকাণ্ড ও গতিবিধি কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মীমাংসা, সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত, সরকার ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয়, সেটিও তিনি মোকাবিলা করছেন। এর পরও ধৈর্যের পরীক্ষায় মুখোমুখি থাকা বিএনপিকে চাপে ফেলার ইঙ্গিত মিলছে নানা ইস্যুতে।
বিশেষত চার দিন আগে রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল চত্বরে ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ওই ঘটনায় বিএনপিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ট্রল (উপহাস) করা হচ্ছে। সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ভাইরালের পর বিএনপি ও তারেক রহমানকে জড়িয়েও অপপ্রচার চলছে, বিক্ষোভ মিছিলও হচ্ছে। আবার বিভিন্ন জনের ফেসবুক স্ট্যাটাস ও মিছিলের স্লোগানে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে বিএনপির ভেতরেও। বিভিন্ন স্থানে ছাত্রদলের বেশ কয়েকজন নেতার পদত্যাগের ঘটনাও ঘটেছে। যদিও এরই মধ্যে ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বিএনপির তিন অঙ্গসহযোগী সংগঠনের পাঁচজনকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীকে দমনের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। কারণ সন্ত্রাসীদের কোনো দলীয় পরিচয় নেই। তবে দলীয় সম্পৃক্ততার কারণে বিএনপি এরই মধ্যে বহিষ্কারের মতো কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী পদক্ষেপ নেয়, সেটি দেখার বিষয়। তারা আরও বলেন, একটি বড় রাজনৈতিক দলের সামনে সম্ভাবনা ও সংকট দুটোই থাকে। বিএনপি এখন এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে—যেখানে ধৈর্যের পরীক্ষা যেমন চলছে, আবার চতুর্মুখী সংকটও তৈরি হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে দলটির কৌশল, নেতৃত্ব ও জনসম্পৃক্ততার ওপরই নির্ভর করবে তারা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে কি না? অবশ্য ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত অপরাধ দমনে কঠোর ছিল বিএনপি। বিশেষ করে ২০০২ সালের ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ এবং এলিট ফোর্স র্যাব গঠন করেছিল। এতে বিএনপির ক্ষতি হলেও তারা অপরাধীকে কোনো ছাড় দেয়নি। এবার প্রয়োজনে আরও কঠোর হতে হবে বলে দলের অনেকেই মনে করেন।
জানা গেছে, পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ীকে পাথর মেরে হত্যার নির্মম ঘটনা বিএনপির জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। দলটির নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সুশীল সমাজের অনেকেই সমালোচনা ও প্রতিবাদমুখর। অনেকে বলছেন, তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীদের লাগাম না টানলে বিএনপির ভাবমূর্তি ধরে রাখা কঠিন হবে। নির্বাচন হলে ‘বিএনপি ক্ষমতায় আসবে’—এমন পরিস্থিতির মধ্যে এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত বিব্রতকর। বিএনপির হাইকমান্ডও এসব ঘটনায় অস্বস্তি ও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। কারণ মিটফোর্ডের সামনে ব্যবসায়ীকে হত্যার ঘটনায় বিএনপির অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা থাকায় জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি), ইসলামী আন্দোলনসহ অনেক রাজনৈতিক দল নিন্দা জানিয়েছে। অনেকের মতে, বিএনপি ‘এখন ক্ষমতায় আছে’। সব রাজনৈতিক দল এই ইস্যুতে বিএনপিকে চাপে ফেলতে উঠেপড়ে লেগেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারেক ও বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কঠোরতা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন স্থানে দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠছে বিএনপির বেশকিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত তদন্ত করে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য মতে, আধিপত্য বিস্তার, নেতৃত্বের রেষারেষি, বিরোধ, মূল সংগঠনের সঙ্গে অঙ্গসংগঠনের মতভিন্নতা, স্বার্থের দ্বন্দ্বে গত বছরের ৭ আগস্ট থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ১১ মাসে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ৪৭৮টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৮১ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। অন্যদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত ১০ মাসে ৬৮ জন নিহত হয়েছেন।
সাংগঠনিক সূত্র জানায়, চাঁদাবাজি, দখল বাণিজ্য ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বিএনপি এরই মধ্যে সাড়ে চার হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার ও শোকজ করেছে। এর মধ্যে বহিষ্কারের সংখ্যা ৩ হাজার ২০০। এ ছাড়া ২ হাজারের মতো নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানো ও সতর্ক করা হয়েছে। এ ছাড়া এসব ঘটনায় ছাত্রদল এখন পর্যন্ত সারা দেশে ৩২৯ জনকে বহিষ্কার ও ৫৪১ নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের কমপক্ষে শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার, দেড় শতাধিক জনকে কারণ দর্শানো, কমপক্ষে ১০০ জনের পদ স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া যুবদলের ১৫০ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে, ৫৬ জনকে শোকজ এবং ৫ জনের পদ স্থগিত করা হয়েছে।
এর পরও পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী হত্যাকাণ্ড দলকে নতুন করে সতর্কবার্তা দিচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপি ক্ষমতায় এলে কী করবে—এমন নেতিবাচক কথাবার্তা জনমনে শুরু হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেটিজেনরা সংঘবদ্ধভাবে নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপির তৃণমূলের লাগাম টেনে ধরার এখনই উপযুক্ত সময় বলে কেউ কেউ মনে করেছেন।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ কালবেলাকে বলেন, “মিটফোর্ডের ঘটনায় সিরিয়াস ব্যবস্থা নেওয়ার পরও, বিচ্ছিন্ন ঘটনায় দায় বিএনপির ওপর চাপানো অপরাজনীতি, এটা নোংরা রাজনীতির চর্চা। বিএনপি ও এর অঙ্গসহযোগী সংগঠন কোনো অপরাধীকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না, কোনো দিন দেবেও না। এক্ষেত্রে বিএনপি অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’। এরই মধ্যে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।”
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দল যখন পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির বিরুদ্ধে সরব; ঠিক ওই সময় পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ীকে হত্যার ঘটনা যেন তাদের কাছে আগুনে ঘি ঢালার মতো। সবাই একযোগে সামাজিক মাধ্যমে নেতিবাচক প্রচার চালাচ্ছে। বিএনপিকে ঘায়েলের জন্য নতুন তৎপরতার চেষ্টা করছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি কিছুটা চাপের মুখে পড়েছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার ঘটনায় তিন সংগঠনের ৫ জনকে সংগঠন থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে। বহিষ্কৃতরা হলেন— যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টু ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবাহ করিম লাকি, স্বেচ্ছাসেবক দলের কালু এবং চকবাজার থানা ছাত্রদলের সদস্য সচিব অপু দাস ও মাহমুদুল হাসান মাহিন।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালবেলাকে বলেন, ‘মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা, এটা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি ভালো না। কেউ যদি অপরাধ করে থাকে তার বিচারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করবে, আদালত করবে। পাথর দিয়ে যারা হত্যা করল তাদের প্রশাসন এখনো কেন গ্রেপ্তার করছে না। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেন ব্যর্থ হচ্ছে? প্রায় এক বছরেও কেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না? এর পেছনে কারা বাধা দিচ্ছে?’
সার্বিক বিষয়ে বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান গতকাল শনিবার কালবেলাকে বলেন, আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য দায়ী সরকার। তাদের দায়িত্ব সন্ত্রাসীদের ধরে শাস্তির আওতায় আনা। মিটফোর্ড এলাকায় ব্যবসায়ীকে হত্যার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, এরই মধ্যে বিএনপি তার অঙ্গসহযোগী সংগঠনের পাঁচজনকে বহিষ্কার করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলেছে। আমি মনে করি, সন্ত্রাসী এবং দুষ্কৃতকারীদের কোনো দলীয় পরিচয় থাকতে পারে না। বিএনপি বহিষ্কারের মতো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরও কেউ যদি কাউকে (বিএনপি) নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে নেতিবাচক প্রচারণা চালায় সেটি দুঃখজনক।
মন্তব্য করুন