সম্প্রতি একদল ডিজিটাল প্রতারক চক্রের তৎপরতা ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে চলেছে। ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে, যেখানে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অভাব এবং বেকারত্বের হার বিপুল, সে সুযোগকে পুঁজি করে একদল অপরাধী ‘সহজে আয়’-এর লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে। তারা বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল ফাঁদ পেতেছে, যার শিকার হচ্ছেন হাজারো তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সের মানুষ। সময় এসেছে এই প্রতারণার স্বরূপ উন্মোচন করে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করার এবং এর থেকে উত্তরণের পথ খোঁজার।
প্রতারণার অভিনব কৌশল : বিশ্বাস অর্জনই প্রথম ধাপ এই প্রতারক চক্রের কার্যপদ্ধতি অত্যন্ত ধূর্ত এবং পরিকল্পিত। এরা হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মতো জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মগুলোকে তাদের প্রতারণার মূল ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়। অনেক সময় বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট দিয়ে বা সরাসরি ব্যক্তিগতভাবে বার্তা পাঠিয়ে (পার্সোনালি নক করে) এরা সম্ভাব্য ভিকটিমের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। যোগাযোগের শুরুতেই তারা নিজেদের কোনো এক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেয়। এজন্য তারা অনলাইন থেকে বা বিভিন্নভাবে সংগৃহীত ভিজিটিং কার্ড থেকে পাওয়া নাম ও পদবি ব্যবহার করে, ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে তাদের পরিচয় যাচাই করা প্রায় কঠিন হয়ে পড়ে। এরপর তারা একটি লোভনীয় ‘পার্ট-টাইম’ চাকরির প্রস্তাব দেয়, যা ঘরে বসেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খুব সহজে করা যাবে বলে আশ্বস্ত করে এবং প্রলোভন হিসেবে মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বা তারও বেশি আয়ের স্বপ্ন দেখানো হয়।
এদের প্রতারণার সবচেয়ে ভয়ংকর দিকটি হলো বিশ্বাস স্থাপন করানো। প্রথমে আপনাকে খুব সাধারণ একটি কাজ দেওয়া হবে, যেমন কোনো ইউটিউব ভিডিও দেখা, গুগল ম্যাপে পজিটিভ রিভিউ দেওয়া বা কোনো ফেসবুক পোস্টে লাইক-কমেন্ট করা। কাজটি সম্পন্ন করে স্ক্রিনশট জমা দেওয়ার পর আপনাকে তাদের তৈরি একটি ভুয়া পোর্টালে ব্যালেন্স দেখানো হয় এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আপনার বিকাশ বা নগদ অ্যাকাউন্টে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মতো সামান্য কিছু অর্থ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই সামান্য প্রাপ্তিই একজন ভুক্তভোগীর মনে বিশ্বাস তৈরি করে দেয় যে, প্ল্যাটফর্মটি আসল এবং এখান থেকে সত্যিই আয় করা সম্ভব। এটি তাদের ‘বিনিয়োগ’ বলা যেতে পারে।
মূল ফাঁদ : বড় টোপ ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া একবার বিশ্বাস অর্জিত হলে শুরু হয় আসল খেলা। ভুক্তভোগীকে আরও বেশি বেতনের লোভ দেখিয়ে নতুন নতুন কাজ দেওয়া হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তার ভুয়া পোর্টালে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা বা তারও বেশি ব্যালেন্স জমতে দেখা যায়। কিন্তু এই টাকা তুলতে গেলেই শুরু হয় আসল প্রতারণা। তখন বলা হয়, ‘অ্যাকাউন্ট অ্যাকটিভ’ করতে বা ‘ক্রেডিট লোড’ করতে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দিতে হবে। সে অর্থের পরিমাণ হতে পারে ৫ হাজার, ১০ হাজার বা এমনকি ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আমাদের কাছে এমন অভিযোগও এসেছে, যেখানে ভুক্তভোগী ১ লাখ টাকা পর্যন্ত খুইয়েছেন।
প্রতারকরা তাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে অন্য সদস্যদের ভুয়া পেমেন্টের স্ক্রিনশট শেয়ার করে একটি কৃত্রিম আস্থার পরিবেশ তৈরি করে। নতুন ভুক্তভোগী যখন দেখে যে ‘অন্যরা’ টাকা পাচ্ছে, তখন সে নিজেও লোভে পড়ে বা নিজের অর্জিত ব্যালেন্স তোলার আশায় তাদের দেওয়া অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেয়। টাকা পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেই নম্বর থেকে তাকে ব্লক করে দেওয়া হয় এবং ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে।
প্রতারণার নেপথ্যে কারা? এই প্রতারণার নেপথ্যে রয়েছে এমন একদল ধুরন্ধর অপরাধী, যাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও প্রযুক্তি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রয়েছে। আমার মতে, এই চক্রটি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কাজ করে। তারা প্রান্তিক অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) ব্যবহার করে সিম কার্ড কেনে এবং সেই সিম দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্ট তৈরি করে। শুধু তাই নয়, অন্যের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে মেসেঞ্জারের মাধ্যমেও তারা যোগাযোগ স্থাপন করে, যা তাদের পরিচয়ে একটি বিশ্বাসযোগ্যতার আবরণ তৈরি করে।
এই চক্র আরও এক ধাপ এগিয়ে বিভিন্ন এলাকায় এজেন্ট তৈরি করে, যাদের ঠিকানা শনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন। অনেক সময় এরা ভিডিও কলের মাধ্যমেও যোগাযোগ করে, যেখানে সেই এজেন্টরাও এক ধরনের প্রতারণার শিকার তাদের অর্থের লোভ দেখিয়ে এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা হয়। এভাবেই মূল চক্রটি নিজেদের আড়ালে রেখে একটি জটিল ও বিস্তৃত নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা প্রায় অসম্ভব।
করণীয় ও উত্তরণের উপায় এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে ব্যক্তিগত সতর্কতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ- উভয়ই জরুরি।
১. ব্যক্তিগত সতর্কতা :
সন্দেহপ্রবণ হোন : মনে রাখবেন, কোনো বৈধ ও স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রামে চাকরির প্রস্তাব দেবে না এবং সহজ একটি কাজের বিনিময়ে হাজার হাজার টাকা আয়ের লোভ দেখাবে না। ‘সহজ আয়’-এর ধারণাটিই একটি ফাঁদ।
যাচাই করুন : কোনো চাকরির প্রস্তাব এলে সেই কোম্পানির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে যান, তাদের অফিসিয়াল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করুন। বিডিজবসের মতো প্রতিষ্ঠিত জব পোর্টালে তাদের বিজ্ঞাপন আছে কি না, তা খতিয়ে দেখুন।
অর্থ প্রদান থেকে বিরত থাকুন : চাকরির জন্য বা নিজের ‘আয় করা’ টাকা তোলার জন্য কোনো কোম্পানিকেই টাকা দিতে হয় না। কেউ টাকা চাইলে ধরে নেবেন, এটি একটি প্রতারক চক্র।
বিকাশ বা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে লেনদেন নয় : কোনো ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে আর্থিক লেনদেন করবেন না। এমনকি ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স দিয়েও এখন মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলা সম্ভব, তাই অতিরিক্ত সতর্ক থাকা জরুরি।
২. প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক উদ্যোগ :
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা : যেসব বিকাশ বা নগদ নম্বরে টাকা পাঠানো হচ্ছে, সে নম্বরগুলো ধরে এই চক্রকে শনাক্ত করা সম্ভব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে আরও কঠোর ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অপরাধীদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং সে খবর গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করতে হবে, যাতে অন্যরা সতর্ক হয়।
সরকার ও গণমাধ্যমের দায়িত্ব : সরকারের উচিত এই বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা এবং গণমাধ্যমগুলোর দায়িত্ব হলো এই প্রতারণার কৌশলগুলো নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করে জনসচেতনতা বাড়ানো।
ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্ট ও ইনফ্লুয়েন্সারদের এগিয়ে আসা : যারা ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্ট বা সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার, তাদেরও এই বিষয়ে কথা বলা উচিত। তাদের একটি ইতিবাচক বার্তা বহু মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে।
কেবল আইন প্রয়োগ করে এই সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা। প্রতিটি মানুষকে বুঝতে হবে যে শর্টকাটে বড়লোক হওয়ার কোনো বৈধ পথ নেই। আমাদের সম্মিলিত সতর্কতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক কঠোর পদক্ষেপই পারে এই ডিজিটাল অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রুখে দিতে এবং হাজারো মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ রক্ষা করতে। নাহলে প্রযুক্তির আশীর্বাদই আমাদের জন্য এক ভয়ংকর অভিশাপও হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক : শামীম আহমেদ, ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড সিইও, আইএম বিডি এজেন্সি লিমিটেড
মন্তব্য করুন