সুশোভন অর্ক
প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৫, ০৭:৩৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শয্যায় পোড়া যন্ত্রণা, বাইরে প্রার্থনায় স্বজনদের বুকফাটা আহাজারি

বার্ন ইনস্টিটিউটের চিত্র
শয্যায় পোড়া যন্ত্রণা, বাইরে প্রার্থনায় স্বজনদের বুকফাটা আহাজারি

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রতিটি কক্ষ এখন যেন যন্ত্রণার একেকটি গহ্বর। যেখানেই চোখ যায়, সেখানেই সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো পোড়া শরীর, যন্ত্রণাক্লিষ্ট অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকা দগ্ধ শিশু অথবা তাদের কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত স্বজনের ভিড়। চিকিৎসকরা দিনরাত এক করে চেষ্টা করছেন রোগীদের প্রাণ বাঁচানোর; কিন্তু মৃত্যুর ছায়া যেন কণ্ঠে চেপে বসেছে। রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় অগ্নিদগ্ধদের বেশিরভাগই এই বার্ন ইনস্টিটিউটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। যাদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

শুধু চিকিৎসাধীনরা নয়, তাদের প্রত্যেক স্বজনের কণ্ঠেই ঝরে পড়ছে জীবনের অসমাপ্ত গল্প, হতবিহ্বলতা, ক্রন্দন, প্রার্থনা। মাইলস্টোন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নাভিদ নেওয়াজ হঠাৎই যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো শ্রেণিকক্ষে বিমান আছড়ে পড়ার সেই ভয়াবহ দিনের একজন ভুক্তভোগী। বিমান আছড়ে পড়ার পর বিস্ফোরণ থেকে আগুন লাগার মুহূর্তে বন্ধুদের নিয়ে স্কুল ভবন থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছিল সে। এতে শরীরের বড় অংশ পুড়েছে তার। চিকিৎসক জানিয়েছেন, নাভিদের শরীরের ৫০ থেকে ৫২ শতাংশ পুড়ে গেছে। তার বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি অনেক রোগী দেখেছি; কিন্তু পোড়া রোগীদের যে কী অসহনীয় যন্ত্রণা, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। আমার ছেলেটা পানি চাইলে দিতে পারছি না। শুধু তাকিয়ে থাকতে পারছি, কিছুই করতে পারছি না। আগে যখন জ্বর হতো, ওকে জড়িয়ে ধরে রাখতাম। এখন তো স্পর্শ করতেও পারি না।’

বার্ন ইনস্টিটিউটের বাইরে বসে ছিলেন একই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাইয়ানের (১৪) স্বজনরা। তার শরীরের পুড়েছে ২০ শতাংশ। চিকিৎসা চলছে ইনস্টিটিউটের হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাইয়ানের ফুফা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাবা-মা ছাড়া কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমরা শুধু বাইরে থেকে অপেক্ষা করছি। ফোনে কথা হয়েছে, তারা অপেক্ষা করছে, কখন রাইয়ান তাদের ডাকবে। একটা দুর্ঘটনা কীভাবে পুরো পরিবারকে তছনছ করে দিতে পারে, আজ সেটা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।’

১১ নম্বর বেডে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে সপ্তম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী মাহতাব আহমেদ। শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া মাহতাব এখন লাইফ সাপোর্টে। তার মামা মহিবুল হাসান শামীম বলেন, ‘আমার ভাগ্নে মারা গেছে বলে কেউ কেউ গুজব ছড়াচ্ছে। এটা ঠিক নয়। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি, সে বেঁচে আছে, চিকিৎসকরা চেষ্টা করছেন। আমার দিকে তাকিয়েছেও সে।’

তার কণ্ঠে ছিল একরাশ ক্ষোভও। মহিবুল বলেন, ‘ঢাকার মতো জনবহুল এলাকায় কেন প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান উড়বে? সরকারের উচিত বিকল্প চিন্তা করা। এমন দুর্ঘটনা যেন আর না ঘটে। আর যেন কোনো মা-বাবাকে কাঁদতে না হয়।’

রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। তাদের পরনে আগুন-প্রতিরোধী পোশাক, মুখে অবসন্নতা আর টানা কাজের ফলে ক্লান্তির ছাপ। কিন্তু কেউই দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন না। এই দুঃসহ বাস্তবতার ভেতরেও কেউ কেউ আল্লাহকে ডাকছেন, কেউ ভগবানকে। কেউ বলছেন, ‘মায়ের মন বলছে বাচ্চাটা বাঁচবে’—আবার কেউ মেনে নিচ্ছেন, ‘আল্লাহ নিলে কিছু করার নাই।’

জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক নাসির উদ্দীন জানিয়েছেন, সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল নিয়ে তারা কাজ শুরু করেছেন। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট চং সি জ্যাকের নেতৃত্বে একটি চিকিৎসক দলের সঙ্গে তারা বৈঠক করেছেন।

নাসির উদ্দীন বলেন, ‘বৈঠকে রোগীদের অবস্থা পর্যালোচনা করে তিনটি ভাগ করেছি। এখানে ক্রিটিক্যাল ক্যাটাগরিতে (সংকটাপন্ন) আট রোগী আছে। তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। তাদের অবস্থা ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিবর্তন হচ্ছে। তাদের বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। সিভিয়ার ক্যাটাগরিতে আছে ১৩ রোগী। ইন্টারমিডিয়েট ক্যাটাগরিতে আছে ২৩ জন। এদের দ্রুত ভালোর দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সব মিলে মোট ৪৪ রোগী এখানে ভর্তি আছে।’

ইনস্টিটিউটের পরিচালক আরও বলেন, ‘রোগীদের এই তিন ক্যাটাগরি আমাদের ডায়নামিক প্রসেস। রোগীদের অবস্থাভেদে এসব ক্যাটাগরি পরিবর্তন হতে পারে। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে এই ক্যাটাগরি করা হয়েছে। আমাদের এখানকার প্রত্যেক রোগী নিয়ে আজ আলোচনা করেছি। কারও অপারেশন লাগবে কি না, কার কী পরিমাণ ড্রেসিং লাগবে, ওষুধ পরিবর্তন হবে কি না—সব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’

সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কতদিন থাকবে, তা এখনো ঠিক হয়নি জানিয়ে নাসির উদ্দীন বলেন, ‘তারা কতদিন থাকতে চায়, সেটা পরে জানাব। সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, বেশকিছু জায়গায় তিনি আমাদের সঙ্গে একমত। কিছু বিষয়ে তিনি আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন। আমেরিকাও আমাদের সহযোগিতা করতে চাচ্ছে। সবার পরামর্শ নেওয়া হবে। এ মুহূর্তে দগ্ধদের বিদেশ নেওয়ার পরিকল্পনা নেই। এখানে যে প্রটোকলে আছে, সেটাই ফলো করব।’

এদিকে দগ্ধদের চিকিৎসায় ভারতের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সদের একটি দল গতকাল রাতে ঢাকায় পৌঁছেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৪৪ দগ্ধ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি আছে আরও ২১ জন। সব মিলিয়ে রাজধানীর পাঁচটি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে বিমান দুর্ঘটনায় দগ্ধ ৬৯ জন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গ্যাসের ট্যাবলেট খেয়ে নিঃসন্তান দম্পতির আত্মহত্যা

‘যারা গণতন্ত্র চায় না তারা নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে’

সারা দেশে টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু কাল, কিনতে পারবেন সবাই

ইউপি সদস্যকে হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামি গ্রেপ্তার

মসজিদ কমিটি ব্যবস্থাপনা নীতিমালার গেজেট শিগগিরই : ধর্ম উপদেষ্টা

নামাজে রাকাত সংখ্যা ভুলে গেলে কী করবেন?

সাংবাদিক তুহিন হত্যা মামলার আরেক আসামি গ্রেপ্তার

সাবেক ছাত্রদল নেতার গলাকাটা লাশ উদ্ধার

পাবিপ্রবিতে ৫ ছাত্রের আমরণ অনশন

আবারও চোটে পড়েছেন রদ্রি

১০

চট্টগ্রামে এনসিপি নেতার পদত্যাগ

১১

শেখ হাসিনা যুব সমাজকে ধ্বংস করে দিয়েছে : এ্যানি

১২

পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচারের দিবাস্বপ্ন কখনোই বাস্তবে পরিণত হবে না : মঈন খান

১৩

জাপার চেয়ারম্যান আনিসুল, মহাসচিব রুহুল আমীন নির্বাচিত

১৪

পরিবহন ধর্মঘটের আহ্বানে লিফলেট বিতরণ

১৫

কারো মৃত্যুর পর ‘চল্লিশা’ খাওয়ানো কি জায়েজ?

১৬

আগামী নির্বাচনে জনগণ বিএনপিকেই নির্বাচিত করবে : রহমাতুল্লাহ

১৭

রেলিং ভেঙে নিচে পড়লেন প্রেমিক-প্রেমিকা, মর্মান্তিক ঘটনা ভাইরাল

১৮

মাগুরায় জিয়া স্মৃতি সংসদের নতুন কমিটি গঠন

১৯

এমন কিছু কথা যা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে না বলাই ভালো

২০
X