ঢাকার পূর্বাচল উপশহরের পাশে আবাসনের জন্য ৩১৪ বিঘা জমি কিনেছে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রতি প্লটে জমির উন্নয়ন ফি বাবদ আদায় হচ্ছে প্রায় ৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া রয়েছে জমির শেয়ারের দাম এবং আনুষঙ্গিক খরচ। আবাসন কোম্পানির মতো জমি বেচাকেনা করে ‘অলাভজনক প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে কর-এ বিশেষ সুবিধা চেয়েছে সংগঠনটি। এতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হলেও কমে যাবে তাদের জমির রেজিস্ট্রেশন খরচ। এ ছাড়া জমি হস্তান্তরের খরচ কমাতে জমির শ্রেণি পরিবর্তনেরও আবদার করেছে সমিতি। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, এনবিআর নতুন উৎসে কর বিধিমালায় বেশকিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। এ ছাড়া আয়কর আইন বিধিতে জমির শ্রেণি থেকে শুরু করে কোন এলাকায় কোন ধরনের করহার হবে—সেটাও নির্ধারণ করা আছে। বর্তমান আইন অনুযায়ী জমি ক্রয়-বিক্রয় বা শেয়ার হস্তান্তরে খরচ ‘বেড়ে যাওয়ায়’ মোটা দাগে বিশেষ কর সুবিধা চেয়েছে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি। এনবিআরে পাঠানো চিঠিতে সংস্থাটি বলেছে, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সমিতি একটি ‘অলাভজনক সংস্থা’। এনবিআরের বিদ্যমান আইনে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। তবে ‘অলাভজনক’ বলে আলাদা কিছু নেই। দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘বিনিমিয় ছাড়া কার্য সম্পাদনের বিষয়টি।’ কিন্তু প্রসাশন ক্যাডারদের এই সংগঠনটি এরই মধ্যে ভূমি উন্নয়ন বাবদ প্রত্যেক শেয়ার গ্রহীতার কাছ থেকে নির্ধারিত হারে অর্থ সংগ্রহ করেছে। একই সঙ্গে যারা চাঁদা পরিশোধ করেছেন, তাদের জমি আলাদা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী এনবিআরের দায়িত্ব কর আদায় করা। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সংগঠনটির কর সুবিধা চাওয়ার বিষয়টি আইনত সাংঘর্ষিক। তাই এনবিআরের উচিত, সংগঠনের ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী যে কর আসবে, তা আদায় করা। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারদের আবাসনে কর অব্যাহতি সুবিধা দিলে ভবিষ্যতে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।’
এনবিআরের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডাররা আবাসনের লক্ষ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের খিলক্ষেত থানাধীন কুড়িল-৩০০ ফিট রাস্তার এক কিলোমিটার উত্তর দিকে তলনা, ডুমুনি, মস্তুল, বাওথার ও ঢেলনা মৌজায় ৩১৪ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন। এসব জমি উন্নয়ন ব্যতীত সাফ কবালা রেজিস্ট্রি মূলে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই জমি ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ বা ‘ঘ’ শ্রেণিভুক্ত না হওয়ায় ‘ঙ’ হিসেবে দাবি করা হয়েছে চিঠিতে। যদিও এই চিঠিতে বলা হয়েছে, সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস থেকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে, এই জমি ‘ঘ’ শ্রেণিভুক্ত। তাই জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্যও এনবিআরের দ্বারস্থ হয়েছেন সংগঠনটির কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে জমিতে কোনো ধরনের উন্নয়ন করা হয়নি উল্লেখ করে উৎসে কর এবং অগ্রিম আয়কর আরোপিত হলে দ্বৈত কর পরিশোধ করতে হবে বলেও দাবি করা হয়েছে সংগঠনটির পক্ষে। এ ছাড়া ব্যক্তিপর্যায়ে জমি হস্তান্তরে ভ্যাট দিতে হবে কি না, সেটারও পরিষ্কার ব্যাখ্যা এনবিআরের কাছে। পাশাপাশি আবাসন কোম্পানি হিসেবে করহার প্রযোজ্য হবে কি না, তা-ও স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারদের বহুমুখী সমিতির পক্ষ থেকে এনবিআরে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে এই সমিতির জমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে করহার আবাসন কোম্পানির মতো হবে কি না—জানতে চাওয়া হয়েছে। এনবিআর এখনো বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে এখানে আইনের বাইরে ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ নেই। কেউ কৌশলে ব্যাখ্যা দিয়ে কর সুবিধা দেন, তাহলে বিষয়টি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি আবাসন গড়ার লক্ষ্যে রাজধানীর পূর্বাচল নতুন শহরের কাছে গ্রিনভ্যালি আবাসন প্রকল্প ও খিলক্ষেত আবাসন নামে শেয়ার আকারে প্লট বিক্রি করে। আর দুটি প্রকল্পের নামে মস্তুল, ডুমুনি, তলনা, ঢেলনা ও বাওথার মৌজার জন্য আলাদাভাবে রেজিস্ট্রেশন ও উন্নয়ন ফি নির্ধারণ করে এই সমিতি। এতে সবচেয়ে বেশি দাম ধরা হয়েছে মস্তুল মৌজায়। সেখানে সাড়ে ১৬ শতাংশ জমির দলিলমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। রেজিস্ট্রেশন ফি ৩৬ লাখ ৬৯ হাজার, আর উন্নয়ন ফি বাবদ ধরা হয়েছে ৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া ডুমুনি মৌজায় দলিলমূল্য ধরা হয়েছে ৯৯ লাখ, তলনা মৌজায় ৬৯ লাখ এবং ঢেলনা-বাওথার মৌজায় দলিলমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৩ লাখ টাকা। প্রতিটি মৌজায় দলিলমূল্য আলাদা হলেও প্রতি সাড়ে ১৬ শতাংশ জমির উন্নয়ন ফি ধরা হয়েছে ৪ লাখ টাকা করে। এর আগে ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর খিলক্ষেত আবাসন প্রকল্পের প্লট বরাদ্দ দিতে একটি বিশেষ সাধারণ সভা আয়োজন করে সমিতি। পরে ১৪২টি শতভাগ নিষ্কণ্টক প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয় সমিতির সদস্যদের মধ্যে। একইভাবে গ্রিনভ্যালি আবাসনের ক্ষেত্রে সদস্যদের থেকে আলাদাভাবে জমির রেজিস্ট্রেশন ও উন্নয়ন ফি বাবদ টাকা পরিশোধ করতে হয়। এতে ১০ কাঠার প্লটের জন্য সদস্যদের মধ্যে পে-অর্ডারও চায় বিসিএস প্রশাসন কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি।
বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির চিঠির বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী নিচ্ছে এনবিআর—জানতে চাইলে সংস্থাটির চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান কালবেলাকে বলেন, ‘বিষয়টি এবারের আয়কর আইন এবং পরিপত্রে স্পষ্ট করা হয়েছে।’ এর বেশি কোনো মন্তব্য করতে তিনি রাজি হননি।
একই বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি সাবেক সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তারের বক্তব্য জানতে তাকে কল করা হয়েছে। মোবাইল ফোনেও খুদেবার্তা পাঠানো হয়েছে। তিনি কোনো জবাব দেননি।
মন্তব্য করুন